প্রচ্ছদসাহিত্য

বাবা- আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ- কিশোর গল্প

কিছুতেই মন বসছিলো না পড়ায়। খোলা বইয়ের পাতার মধ্যে ভেসে উঠছিল আলেকজান্ডারের মূর্তিটা। টগবগ করে সামনে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছেন, হাতের বড় তলোয়ারটা রোদে ঝলমল করছে। শত্রুসৈন্য চিৎকার করতে করতে চারদিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ছে।

আজ থেকে ‘কল্পনা’ হলে ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’ শুরু হবে। কিছুতেই কথাটা ভুলতে পারছিলাম না। কিছুদিন আগেও ‘ফ্লাইং কার্পেট’, ‘জাম্বো দি গ্রেট’ ফিল্ম দুটো মিস করেছি। আজ থেকে আবার ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’। আগের ফিল্ম দুটো দেখে এসে কামালরা সবাই ক্লাস মাতিয়ে রেখেছিল। সুযোগ পেলেই ক্লাসে বেঞ্চি থেকে উঠে এসে ফিল্মের সব গল্প করত। তারপর জোরে হাততালি একসঙ্গে। বারে বারে ভাবলাম, এবার যেমন করেই হোক ফিল্মটা দেখতে হবে। কিছুতেই মিস করা চলবে না। ইতিহাস বই খুলে আলেকজান্ডারের ছবিটা খুলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ঘরের পাশ দিয়ে মা যেতেই ছবি দেখা বন্ধ করে জোরে জোরে পড়তে সুরু করলাম। কতক্ষণ যে এভাবে পড়েছিলাম মনে নেই। হঠাৎ করে ছোট আপা ঘরে ঢুকে বললেন, এতক্ষণ ধরে কী পড়ছিস আবোল তাবোল?

-আবোল-তাবোল? ভীষণ রাগ হলো আপার ওপর। সবসময়েই উনি যেন আমার খুঁত ধরতে আসেন। ঠোঁট উল্টে বললাম, আবোল তাবোল কিসের আবার? বইতে যা লেখা আছে তাই পড়ছি।

-বইতে লেখা আছে? তাই নাকি? আচ্ছা দেখা তো বইতে কোথায় লেখা আছে আলেকজান্ডার সাত বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন? এগিয়ে এসে বলেন ছোট আপা। বেণীদুটো ঝুলে পড়ে টেবিলের ওপর।

-এই দ্যাখো না। আঙুল দিয়ে বইয়ের একদিক দেখিয়ে দিলাম।

সেদিকে তাকিয়ে আপার মুখটা সন্ধেবেলার আকাশের মতো গম্ভীর হয়ে গেল।

-মিথ্যে পড়ার ভান করিসনে খোকা। যা পড়বি ভাল করে পড়লে তোরই লাভ হবে। পড়ায় ফাঁকি দিলে ক্ষতিটা কার হবে বলতে পারিস? আমাদের নয়।

কথাগুলো বলেই ছোট আপা চলে গেলেন সেখান থেকে। রাগে আমার চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। কে ডেকেছিল শুধুশুধু উপদেশ দিতে? পড়তে আর ইচ্ছে হলো না। বইটা বন্ধ করে ঘরের বাইরে চলে গেলাম।

পরদিন স্কুলে যেতেই কামালের সঙ্গে দেখা। আমার ঘাড়ে সজোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল, হ্যালো ফ্রেন্ড, খবর ‍শুনেছিস?

আমি না-জানার ভান করে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, কিসের খবর!

-শুনিসনি তা হলে?

-না তো!

-কোন তিমিরে আছিস তুই? কল্পনা হলে ‘আলেকজান্ডার দি গ্রে’ শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। চল, ম্যাটিনি শো দেখে আসি আজ।

পকেট থেকে দু’টাকা বের করে কামাল দেখাল। তখনো আমার পয়সা জোগাড় হয়নি। মুখে হাসি টেনে এনে বললাম।, চল তা হলে সবাই একসঙ্গে যাই।

-পয়সা জোগাড় করেছিস তো!

-বাড়ি থেকে ম্যানেজ করে নেব!

-অল রাইট। চল, ক্লাসে ঢোকা যাক।

ক্লাসের দিকে এগিয়ে চললাম দু’জন।

টিফিনে পেটব্যথার নাম করে ছুটি নিলাম হেডমাস্টারের কাছ থেকে। বাড়ি ঢুকে বই আর খাতা একে একে রাখলাম টেবিরের ওপর। খাওয়া শেষ করে দুপুরে মা, আপা সবাই ঘুমুচ্ছেন। সকালে কিছু পুরোনো খাতা বিক্রি করেছিলাম। পঞ্চাশ পয়সা পকেটে আছে। দরকার আরো দেড় টাকার। মা’র জমানো পয়সা কোথায় থাকত জানতাম। শোয়ার ঘরে কুলুঙ্গির ওপর একটা কৌটোর ভেতর মা পয়সা জমিয়ে রাখতেন। কতদনি দুপুরে ওখান থেকে পয়সা সরিয়েছি, মা টেরও পাননি। আজও অনুবিধে হলো না। ঘুমন্ত মা’র দিকে চেয়ে পা টিপে টিপে দেড় টাকা বের করে নিঃশব্দে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। বাইরে কামাল, জামান, আমজাদ সবাই অপেক্ষা করছিল। ওদের কাছে যেতেই ঘিরে ধরল।

-পেয়েছিস?

মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। মা কি আর সহজে দিতে চায়! অনেক কষ্টে আদায় করেছি।

-পেয়েছিস যখন তখন আর কি। চল, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। বেশি দেরি হয়ে গেলে আবার টিকেট পাওয়া যাবে না। সবাই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। মনটা আনন্দে ভরে উঠল আমার। এতদিন পর আমার প্রিয় আলেকজান্ডারকে পর্দায় দেখতে পাব।

সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে হাতে বইপত্র নিয়ে চুপিচুপি পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। কেউ কোনো সন্দেহ করল না, এমনকি ছোট আপাও নয়। ওরা সবাই ভেবেছে অন্যান্য দিনের মতো আমি স্কুল থেকে এসেছি।

খানিক্ষণ পর পড়তে বসলাম। পড়ায় কিছুতেই মন বসছে না আজ। চোখের সামনে ভাসছে সিনেমার দৃশ্যগুলো। সম্রাট আলেকজান্ডার, সেলুকাস, অস্ত্রের ঝনঝনানি, আহত সৈনিকদের আর্ত রব, ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ সব মিলিয়ে আমার কাছে একটা অপূর্ব সুন্দর অনুভূতি। এভাবে কতক্ষণ অভিভূত হয়ে ছিলাম জানিনে। পাশের ঘরে মা-বাবার কথা কানে আসতেই সজাগ হয়ে উঠলাম।

বাবা এখুনি অফিস থেকে ফিরেছেন। জামা খুলে চেয়ারে বসেছেন বোধহয়। মা বাবাকে বলছেন, তোমার শার্টটা আর বেশি দিন পরতে পারবে না। অনেক জায়গা ফেঁসে গেছে।

-সেলাই করে দিও বরং। বাবার কণ্ঠস্বর।

-এভাবে সেলাই করে তো আর শার্টের আয়ু বাড়াতে পারবে না। তার চেয়ে একটা নতুন শার্ট তৈরি করে নাও। সবাই বলছে আজকাল কাপড়ের দাম অনেক কমেছে।

-এ মাসটা এটা দিয়েই চালাই কোনোরকমে। আসছে মাসে নাহয় দেখা যাবে। খোকার একটা শার্টে চলে না। অনেক জায়গায় যেতে হয় ওকে। এ মাসে ওর জন্যে একটা শার্ট করতে হবে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। বাবা বোধহয় চা খাচ্ছেন। হঠাৎ মা বলে উঠলেন, একি?

-কী হলো আবার? বাবার চোখে খানিকটা বিস্ময়।

-আজ দুপুরেও কিছু খাওনি তুমি? অফিসে সারাদিন এত খাটো তুমি, সামান্য টিফিনটাও খাবে না। এভাবে ক’দিন শরীরটাকে টিকিয়ে রাখবে তুমি?

-ভাল্লাগে না ঐসব আজেবাজে জিনিস খেতে। বরং টাকাটা জমালে অনেক উপকার হবে। খোকার স্কুলের মাইনে, খুকির কলেজের মাইনে ওখান থেকেই দেওয়া যাবে। তোমার কৌটোতে ওটা রেখে দাও।

আমার হাত থেকে বইটা টেবিলের ওপর থেকে নিচে পড়ে গেল। চোখ ‍দুটো ভয়ানকভাবে জ্বালা করে উঠল। কে যেন ভেতর থেকে সশব্দে চাবুক মারল আমাকে। প্রথম বুঝতে পারলাম, এতদিন ধরে কী অন্যায় করে করে এসেছি। বাবা না-খেয়ে আমার জন্যে পয়সা জমাচ্ছেন, আর সেই পয়সা দিয়ে আমি সিনেমা দেখে ফুর্তি করেছি বন্ধুদের সঙ্গে। বইয়ের দিকে তাকাতেই আলেকজান্ডারের মুখের বদলে চোখের সামনে ভেসে উঠল বাবার গোঁফদাড়িভর্তি শুকনো মুখটা। আমার মনে হলো, তিনি কারুর চেয়ে কোনো অংশে কম নন, বরং আলেকজান্ডারের তুলনায় অনেক বড়, অনেক বড় ভালোবাসার সম্রাট।

 

আরও পড়ুন- সেরা অনুবাদ গল্প

error: Content is protected !!