প্রচ্ছদফিচার

খসরু পারভেজের সমাজ দর্শন- মুস্তাক মুহাম্মদ

কবি তার ধ্যানের মাধ্যমে দূরকে করে কাছে। যে যুগে কবি বসবাস করে সে যুগ ছাড়িয়ে যায় কবির চিন্তা – চেতনা।এ জন্য সমসাময়িক সমাজের খুবই কম মানুষেরবোধ্যগম হয় কবির চিন্তা। আর অধিকাংশের না হওয়াটা স্বাভাবিক। এ জন্য পাঠক বলে , কবিরা স্বপ্ন বিলাসী। তবে কোন কোন কবি স্বপ্নের আড়ালে স্বেচ্ছাচারিতভাবে উদ্ভট স্বপ্ন দেখে; যার কোনো মানে হয় না। কবিরা স্বপ্ন দেখবে। সাধারণের কাছে তা উদ্ভট হলেও কালে কালে তা দৃশ্যমান হবে।

পৃথিবী বিশাল এক পাঠশালা। এই পাঠশালার সকল কিছু জানা একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু আমাদের জানার আগ্রহ থাকতে হবে । ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে যতোটুকু জানা যায়। অর্জিত জ্ঞান মানুষের কল্যাণে সর্বোচ্চ ব্যয় করতে হবে। সক্রেটিস বলেছিলেন ,নিজেকে জানো” । নিজেকে যে বেশি জানে সে তার জগতকে জানে , সে তার সৃষ্টিকর্তাকে জানে। আপন ভুবনে বাস করে ঈশ্বর । নিজেকে আবিষ্কার করার মাধ্যমে ব্যক্তি স্রষ্টা সৃষ্টি তথা যাবতীয় বিষয়াবলী জানতে হয়। নিজেকে জানান মানুষের মাধ্যমে সমাজে কল্যাণের প্লাবন বেয়ে যায়। এজন্য একজন মানুষের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা হওয়া উচিত নিজেকে চেনা , নিজেকে জানা। নিজেকে যতটুকু মানুষ জানবে ততটুকুই তার সম্পদ। নিজেকে জানার সাধনায় আসুন আমরা ডুব দেয় । কবি খসরু পারভেজ এভাবে নিজের কাছে ফিরেছেন –

কেবলমাত্র নিজেকে তুমি নিকট থেকেই দেখো/

খুব কাছ থেকে জীবন না দেখলে/

অচেনা থেকে যাবে জীবন /

জ্যোতিষীর মতো নিবিড় হও নিজের কাছে”

(দূর থেকে কাছে: সক্রেটিসের সাথে)

 

অস্থির পৃথিবীতে চলতে গিয়ে আমরা হিতাহিত জ্ঞান হারািেছ। দ্রুত বেগে চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছি। মুহূর্তেরমধ্যে পৃথিবী পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। যার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা গড্ডলিকার প্রবাহের মত চলছি। কোথায় চলছি তা জানি না। জানতে গেলে পিছিয়ে পড়বো! চলতে হয় তা চলছি। এভাবে চলতে চলতে একদিন অপমৃত্য বা বলির পাঠা হবো আমরা। কিন্তু সুখ সমৃদ্ধি আমাদের অধরা থেকে যাবে। পেতে হবে – আরও সামনে- আরও সামনে আমাদেরকাঙ্খিত ….। গাধার সামনে মুলা ঝোলানোর মত অবস্থা। আমরা মুলার পেছনে শুধু দৌড়াচ্ছি। কিন্তু সেটা কি আমরা আদেও পাব ?  কবি খসরু পারভেজ লিখেছেন –

“আমি চিৎকার করে বলি থামুন ,থামুন ,থামুন . . ./

এই তো, এই তো সেই সাধের ভুবনপুর।/

ব্যসÍ যাত্রীদল তখনও বলছে, জোরে. . .আরও জোরে”

(ভুবনপুর: সক্রেটিসের সাথে)

মানুষেন চরিত্রই আসল সম্পদ ( আচার -ব্যবহার , কথা বার্তা )। লোক দেখানো আচারণ করেশুধু ভণ্ডরা। সমাজে আজ ভণ্ডর হাতে। কবি হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন , “সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে”। যা ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে গিয়ে নাভিঃশ্বাস ফেলছে। সেখানে এক শ্রেণীর কপাটচারীরা শোষণ করে সমাজ , মানুষ। বিশ্বটাকে নিজেদের খেলার পুতুলে পরিণত করেছে। গোটা মানচিত্রটা তাদের ইচ্ছেয় চালাতে চায়। কিন্তু আমাদের সকলের চাওয়া মানুষ হওয়া। অর্থ বিত্ত আমাদের মানুষ থেকে দূরে নিয়ে যায়। অর্থ- ক্ষমতার মোহে আমরা মানুষ থাকছি না। শোষক ভণ্ড হয়ে যাচ্ছি। হয়ে যাচ্ছি ভালোর প্রতিপক্ষ । মনে রাখতে হবে অর্থ -বিত্ত , ভোগ – বিলাশ , ক্ষমতা কখনো সুখ- শান্তি দিতে পারে না। কবি খসরু পারভেজ এই সব কথামালা এভাবে সাজিয়েছেন-

আমার বাবা ছেঁড়া জামা পরতেন/

হাট থেকে ফেরার পর দেখি ছেঁড়া জামার ছিদ্রে/

আঙুল ঢুকিয়ে আরও ছিঁড়ে দিয়েছে কেউ/

আমার খুব কষ্ট হয়েছিল, দুঃখ পেয়েছিলাম সেদিন/

এখন ছেঁড়া জামা পরা মানুষ দেখলে দুঃখ হয় না/

কেননা ছেঁড়া জামার ভেতরে যে ভালো মানুষ থাকে /

এখন দামি দামি জামার ভেতরেও সেই মানুষ নেই।

(দুঃখ: সক্রেটিসের সাথে)

আত্মনির্ভরশীলতাই শক্তি। আত্মনির্ভশীল না হয়ে পরের বোঝা হয়ে থাকা জীবন জীবন নয়। এটাতে আত্মা মরে যায়। আপন পরিচয় মুছে যায়। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলাদেশের কথা বলে আমাদেরস্বপ্ন দেখায়েছিল । আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম। বাংলাদেশ একদিন সোনার বাংলাদেশ হবে। কিন্তু সে মানুষটাকে হত্যা করার সাথে সাথে আমাদেরস্বপ্ন অধরা থেকে গেলো। দেশে কতজন সোনার বাঙলা গড়ার জন্য আমাদের খোয়াব দেখালো। আমরা দেখালাম । কিন্তু তারা ক্ষমতায় এসে, আমাদের শোষন করে । আমাদেরস্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আহারের ফসল বেঁচা টাকায বিদেশে ফাইভ স্টারেভুরিভোজ – ললনাদের উরুর রূপের ঝলকে সব খুয়ে আসে । আমাদের আবার স্বপ্ন দেখায় – কাজ এগিয়ে রেখে এসেছি আবার যেতে হবে। আবার আমরা মাথামোটা বাঙালি খোয়াব দেখি । কষ্টে থেকেও তাদেরবিশাল বহরের বিদেশ যাত্রার খরচ বহন করি । তারা যায় আমাদের স্বপ্নর চারা কিনতে । এই বিশাল খরচ বহন করতে করতে একদিন আমাদের দেহর শুকনো মাংস মাটিতে মিশে যায। স্বপ্ন তেমনই থেকে যায়। আমরা স্বপ্ন দেখি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ । তার জন্য আবার আমরা হাতের পাঁচ দিয়ে দিই। সুইচ .ব্যাংকে সব জমা হয় । আমাদের ভাগ্যও পরিবর্তন হয় না। বিদেশে বাড়ি , অবসর জীবনযাপনের জন্য চলে স্বর্গ বানানোর কাজ , সন্তানেরা চাষাভুষার দেশ ছেড়ে অন্য দেশের মেকি মানুষ হয়। যার মাটির সাথে কোনো সংযোগ থাকে না। আার আমরা দিনে দিনে আরও দুর্বল জীর্ণ হতে থাকি । আমাদের কিছুই হয় না। আসুন আত্মনির্ভরশীল হোয়। গাল গল্প আর মঞ্চের ঝড় তোলা ফাঁকা বুলির পিণ্ডি চটকায় । তা দুপায়ে ডলে – নিজেরা হাত দিই সোনার বাংলা গড়ার । কবি খসরু পারভেজ দৃঢ়তার সাথে আহ্বান করেছেন –

ওদেরকে আজ আর সুবর্ণগ্রামের কথা বলে লাভ নেই/

ওরা আমাদের কোনো অরণ্য ফিরিয়ে দেবে না/

তার চেয়ে আসুন আমরা আমাদের উঠানের পাশে /

কটি করে নতুন গাছের চারা রোপন করি ।”

(বৃক্ষবধ ১: সক্রেটিসের সাথে)

কবর বিক্রির টাকাতেও দিতে হয় পৌরকর – ভ্যাট/

তাই আরও লাশ চাই . . . আরও আরও মৃত্যু চাই/

যত মৃত্যু তত ভ্যাট, তত উন্নয়ন”

(সক্রেটিসের সাথে)

বাঙালি সমাজ কলুষিতায় ভরে গেছে। এখন আর কারোর উপরেভরসা করা যায় না। মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে আমরা এক অভাগা জাতিতে পরিণত হয়েছি। আামাদের হিতাহিত জ্ঞান হারায়ে গেছে। আমরা সত্য – মিথ্যা , সাদা -কালো পার্থক্য বুঝতে অক্ষম । আমরা অথর্ব জাতিতে পরিণত হয়েছি। শযতানের রাজ্য এখন চলছে। একজন মানবিক হৃদয় সম্পন্ন মানুষের আকাল । একটি দেশ এভাবে চলতে পারে না। আমাদেরআগামি প্রজন্ম ধ্বংস হচ্ছে। তারা অনিয়মকে নিয়ম মনে করে- তা বাস্তবায়নে মরিয়া । আমাদেরএই চরম অবনতি হতে এখনি মুক্ত হতে হবে । আমাদেরমানুষের পৃথিবী গড়ার জন্য কাজ কাজ করতে হবে।এখন একটি বিপ্লব অত্যাবশ্যক। এই বিপ্লব হবে মানবিক পৃথিবী গড়ার বিপ্লব । ভণ্ডদেরমুখের কথা বিশ্বাস না করে তাদেরকে মাটিতে নামিয়ে আনতে হবে। আমাদেরমানবিক গুণাবলি বাড়াতে হবে। আসুনু আমরা অন্ধকার নিমিজ্জিত সমাজকে খান খান করে আপরোময় মানুষের পৃথিবী গড়ি।

কবি খসরু পারভেজ সমাজবিজ্ঞানীর মতো পুরুষের র্কতৃৃত্ব – শাসন শোষন করার অন্ধকার দিক খুঁজে বের করেছেন এভাবে-

“বোনের সম্রম হারিয়েছে পথে/

মায়ের শরীরে কলঙ্কের কালোদাগ/

আমার পিতাও নাম লিখিয়েছে ধর্ষকের দলে /

কী করে দেখাই কালনেমি মুখ।”

(পুরুষপুরাণ : সক্রেটিসের সাথে)

কবি খসরু পারভেজের আধুনিক যুগের কবিতায় এসেছে- মানবতা , সমাজ ও যাপিত জীবনের নানা সংকট সমস্যার তৃণমুর দলিল ।সমাজের অসংগতিগুলো তুলে এনেছেন দক্ষ শিল্পির মত। কত নিখুঁত চিত্র তিন একেছেন!মানবিক মূল্যবোাধ জাগ্রত করে অসাম্প্রদায়িক মানুষের পৃথিবী গড়ার জন্য আমাদেরএগিয়ে আসতে হবে । চরিত্রহীন ভণ্ডদের পরাজিত করতে যে বিপ্লব প্রয়োজন সে বিপ্লবের অগ্র সৈনিক আমরা । আসুন বিপ্লব করি নতুন একটি মানুষের পৃথিবীর জন্য।

 

আরও পড়ুন- সুজন সাজুর কবিতা

error: Content is protected !!