জামিল হাদীর অণুকবিতা
১. প্রহসনিয়তি
নোট আর ভোটের পৃথিবীতে তোমার দেয়া চোটে,
আমি কপাল রেখে হাসতে থাকি সেলাই হওয়া ঠোঁটে।
২. অসংসদীয়
আমি টিসিবির পেছনে মানুষের লাইন।
তুমি কালো টাকা সাদা করে ফেলা প্রিয় আইন।
৩. মৃত্যু সনদ
গাছের ভয় খেয়েছে করাতের দাঁত,
আসবাব জানেও না কী যে তার জাত!
৪. ক্রমক্ষয়মান
হারানো দিনের ক্ষোভে রাত জেগে থাকা,
সূর্য ওঠার জানি নেই কোনো শাখা
৫. সং বোধ
হেক্টরই হয়েছি আমি।
পায়ে দড়ি বেঁধে,
অ্যাকিলিস জীবন
ঘোরায় আমায় তামাম দুনিয়া…
৬. সাদা-কালো-রঙিন-সাদা
বাইরে থেকে পাহাড় লাগে, ভেতরে তার ঝর্ণা।
শুরুতে মানুষ নদীই থাকে বিরান… ধুধু.. চর না।
৭. স্বাধীনতা
বিস্ফোরিত হতে পারমাণবিক বোমার অনুমতি লাগে। আগ্নেয়গিরির লাগে না।
৮. আয়নান্তর
উচ্চারণের ফারাক কেবল, অর্থও নয় সুপ্রাচীন।
সব ভাষাতে ডিপ্রেশনের অভিন্ন নাম── আত্মহীন।
৯. ক্ষত সাময়িকী
খুব খাপছাড়া লাগে…
যখন দেখি রাত হয়ে গেছে পিঁপড়ে
আর আমি তার চিনির দানা।
১০. বিচারক
ঝড় বন্ধু না হলেও শত্রু না।
দেখিয়ে দিয়ে যায় কার আস্থা তুলোর মতো আর কারটা পাথরের।
১১. অহংকার
যতক্ষণ বাতাস থাকে,
ঘুড়ি নিজেকে পাখি ভাবে।
১২. পাখি
পুড়ছে ডানা, উড়ছে তবু ছাই হওয়া পালকে।
আকাশ তাকে দেখছে না আর বিরুদ্ধতার চোখে।
১৩. শীর্ষ সাক্ষ্য
জাহান্নামে যাক পথ, তবু তুমি চালু রেখো পা।
গন্তব্যের আরেক নাম── চিরস্থায়ী প্রতিকূলতা।
১৪. আয়নাহীন
খলনায়কের প্রলয় দেখি। কেন সে এমন তা কি জানি?
গর্জন ভাবছি যা, হয়তো সেটা সমুদ্রের গোঙানি…
১৫. বিয়োগাংশ
বাধ্য হয়ে শুনছি যখন নিজেই নিজের কথা।
আমায় দেখে হাসছে তখন অন্যমনস্কতা…
১৬. শব্দাঙ্গী
স্বীকৃতি ছাড়াই তো রোদ নেয় বারান্দার ঘ্রাণ
প্রমিত বাংলা তুমি আমি যার আঞ্চলিক টান।
১৭. রি-ক্ত-কো-ণ-মি-তি
খুঁজো না কারণ।
ময়নাতদন্তেরা
বৃষ্টি প্রবণ..
১৮. দখল
পিয়ানোর সাদা থেকে কালো কর্ডে যাবার মাঝের সময়টুকুতে,
আঙুলের শূন্যতাতেও তুমি আমার।
১৯. শূন্যহংকার
ফিরতে নেমে দেখি─
পথের পা-ও আমার মতো মেকি!
২০. বন্ধু
ঘাসই জানে শুধু,
পাতার জীবন ছিলো ধুধু।
২১. বিভ্রম
খুঁজছে পাখি খাঁচা।
সে কি আকাশ চেনায় কাঁচা?
২২. রক্ষক
শস্য খেলো কীটে,
কাকতাড়ুয়া রোদ পোহালো পিঠে।
২৩.স্বার্থ
রক্ত মাখার পর,
ছুরি হলো পর।
২৪. আশ্রয়
গাছের ছায়া খুঁজি।
গাছও এমন ছায়া খোঁজে রোজই।
২৫. দাম
যুদ্ধবন্দী জানে,
মুক্তিপণের মানে।
২৬. দ্বিতীয় নেই
কে আর আমার মতো!
তোমার দুর্যোগে দুর্গত?
২৭. সমাচার দর্পণ
জীবন দৈনিক পত্রিকা।
কেউ খবর, কেউ বিজ্ঞাপন।
উৎসবগুলো সম্পাদকীয়।
সময় পাঠক।
২৮. আত্মনাশী
অহমিকা আদতে স্ব-বিনাশী প্রতিরক্ষাব্যূহ।
ভিজে গেলে দেশলাই আগুনের জীবন দুরূহ।
২৯. শূন্যাধার
ঘুরছে লাটিম বনবনিয়ে
ধুলোর পরে ঐ।
কাঁপছে সুতো একলা একা,
তার পৃথিবী কই?
৩০. জীবন
নোনা ধরা বহুতল ভবনের মতো।
বার বার রং করে যেতে হয়।
৩১. স্রষ্টা
লিখবে আঙুল, ভাঙলে ভাঙুক সব কলমের নিব।
গাছ কখনো নেয় না জানি মেটারনিটি লিভ।
৩২. হৃদয়ে…
তারা কেউ পাশাপাশি নেই
তবু তারা ভেবে নেয় আছে।
জানালা যেমন ভাবে
চাঁদ তার খুব খুব কাছে।
৩৩. আলো
হারিয়ে ফেরার পথ আঁধার যখন নিরুপায়,
পথ দেখাতে সূর্যফুল উঠে আসে পাতার খোঁপায়।
৩৪. স্মরণালয়
দূরত্ব যতই হোক, পথ জানে
কে কোথায় ঠিকই!
ভালোবাসা বুদ্ধদেবের
রেখে যাওয়া কবিতা সাময়িকী।
৩৫. আব্বা
সবাইকে সমান চোখে দেখতে গিয়ে
প্রথমে হারিয়ে ফেলেন চশমা।
তারপর চোখ।
৩৬. যাত্রা
পায়ে পায়ে এগোলেই পথ জ্বালে শিখা।
পথই তো পায়ের একমাত্র প্রেমিকা।
৩৭. বেকার
সকালে লজ্জা-শরম খেয়েছি।
দুপুরে খাবো সম্মানজনক জীবিকা।
রাতে নিজেকে।
৩৮. কুচক্রী
যেহেতু করি তোর বিরুদ্ধে
Legal ষড়যন্ত্র
তাই Illegally চেপে ধরিস
আমার স্বরযন্ত্র।
৩৯. Out Law
ভালোই লাগে মাকড়-জীবন
সব কিছুতেই স্বাদ!
কারণ
মানুষ হয়ে বাঁচতে চাওয়া
আইনত অপরাধ।
৪০. শব সমিতি অথবা মৃত্যুপরায়ণ
কফিনে পেরেক ঠুকি… ঠক্,ঠক্,ঠক্।
পেরেক, তোমারও কি লাশ হবার শখ?
৪১. সাহসিকা
যাকে ডাকো প্রজাপতি; সেতো ছিলো শুঁয়োপোকা আগে।
সব মুখ সুন্দর― মেনে নিতে যোগ্যতা লাগে।
৪২. অমনসিক
মনে যে রাখে না তাকে মনে রেখে যায় ক্ষয়ে…
মানুষ বোধহয় বেঁচেই থাকে মনখারাপের আশ্রয়ে…
৪৩. লোভীজাত্য
উড়তে জানো না তাই পাখি ধরে আনো।
তোমাদের প্রেম এমনই… ঈর্ষা মাখানো!
৪৪. ইতিবৃত্ত
সময় আর মৃত্যু, ছুটছে যে যার মুখোমুখি।
সংঘর্ষ দেখতে, মানুষ নেয় জন্মানোর ঝুঁকি।
৪৫. জীবন্বেষী
কিছুটা নিয়তি ছিলো, কিছুটা নিজের গড়া ফাঁদ।
পঞ্চমীর চাঁদ দেখে, আমার হলো বাঁচবার সাধ!
৪৬. উধাও
জাদুকর বলে —
‘জাদু দেখাবো?
মন… ভালো হয়ে যাবে ভাই!’
আমি বলি —
‘জাদু দিয়ে দ্যাখো আগে মন আছে না কি নাই!’
৪৭. পথ – সী মা না
পথই শুধু জানে তার, কোথায় হয়েছে পথ শেষ।
পথিক তো কৌতুহলে, মেনে চলে পায়ের আদেশ…
৪৮. নিঃস্ব ধনী
খড়কুটো ভেবে যাকে করে চলো মিথ্যে উপহাস
তার কি আছে তোমার মতো অথৈ জলে ডুবে যাবার ত্রাস?
৪৯. অচল-মৃত্যু
অমরত্ব বিক্রি হচ্ছে, কিনতে গিয়ে দেখি!
জমিয়ে রাখা মৃত্যুগুলো, বিনিময়হীন…. মেকি!
৫০. অনন্যোপায়
চোখ তো বোবাই হয়
তবু সে জানাতে জানে তার জিজ্ঞাসা!
আগুনের মুখ নেই,
আছে শুধু ছাইয়ের পিপাসা….
৫১. স্বাধীন বন্দী
খাঁচার বাইরে এসে দেখলো সে পাখি।
স্বাধীন! তবুও সে উড়ছে… একাকী
৫২. গন্তব্য
সর্বজয়ী বীর যে, তারও কি হয় সবকিছু জেতা?
আজ যে কফিন বেচে, কাল সে-ও কফিনের ক্রেতা।
৫৩. বেমানান
মুখোশ খুলে মুখের সামনে,
যেই ধরেছি আয়না!
আয়না বলে―” দুঃখিত ভাই,
তোমাতে মুখ মানায় না।”
৫৪. সন্ধি বিচ্ছেদ
অনেকে সন্ধি করেও বিচ্ছেদ এড়াতে পারে না..
৫৫. শোনো!
সিন্ধু ঈগল… শোনো!
আমার মতো
বন পুড়িয়ে উড়োনা কক্ষনো!
৫৬. সারশূন্য
সহানুভূতি― তত্বীয়
আর
বাঁচা― ব্যবহারিক
বৃষ্টি যেমন হঠাৎ হঠাৎ
তুমুল সাম্প্রদায়িক..
৫৭. জীবন-মরণ-জীবন
পেরেকের দু প্রান্তেই জীবন থাকে।
একটা হাতুড়ির ঘা খায়
তো
আরেকটা দেয়াল-বন্দী।
৫৮. কৌতুকাশ্রম
ভেসে ভেসে, ঝরা পাতা,ছুঁলো মাটির গা।
হেসে হেসে, নতুন পাতা, করলো অবজ্ঞা!
৫৯. সাইরেন
ভেসে ভেসে,
ঝরা পাতা,
ছুঁলো মাটির গা।
নতুন পাতা
জেনে গেলো তার
বিদায় প্রতিজ্ঞা।
৬০. হৃতসর্বস্ব
যে চোখের আলো বেচে,
দূরবীন পেয়েছে অনুদান।
আমি সেই আলোকসজ্জা,
তুমি যার বিপণি বিতান…
৬১. তুরুপের দাস
লুডুর দানে ছয় উঠলো যেই,
খুশী হতে গিয়ে দেখি, ঘর গুনে পা পড়েছে সেই
সাপের মুখেতেই..
৬২. জলোপোন্যাস
তোমাকে
পানির গায়ে লিখেছিলাম।
তাই
প্রতিবারই
মিলিয়ে গেছো…
৬৩. অঙ্কুরোদগম
বিখ্যাত হবার পর সবাই জেনে গেলো,
মানুষটা ভ্রুণহত্যায় কিংবদন্তী!
৬৪. ডাক টিকিট
চিঠি’র কান্না শুনতে শুনতে,
বিরক্ত হয়ে খাম থেকে খসে পড়লো,
ঝরা পাতার মতো।
৬৫. চাকা
ঘুরে যাবে নদী..
বদলাবে তীরও…
আজ যাকে মৃত দ্যাখো
কাল ছিলো চির!
৬৫. ইচ্ছেকল্প
মনে মনে গাছ যতবার একা ওড়ে;
বয়েসী পাতা,
পালকের মতো
ঝরে গিয়ে তার
ওড়া সার্থক করে।
৬৭. বোবা তার্কিক
ঘাস বলে গাছ ধনী, গাছ বলে ঘাস।
মাটি শোনে… একমনে… সবার বাহাস।
৬৮. জন্মান্ধ
পৃথিবী দ্যাখে
পাখির চোখে…
৬৯. মহা মড়ক
আমরা নফসের সাথে লড়তে পারিনা।
তাই রাস্তার নামকরণ হয়ে পড়ে থাকি।
রাস্তা হতে পারিনা!
৭০. জাল জীবন
শেকড় গড়ি… নকল করে… গাছের মত যেই!
দেখি আমার পাতার পরে ভোরের আলো নেই।
৭১. সমকক্ষ
ইটে-ইটে গেঁথে গেঁথে মাথা তোলে বিশাল অট্টালিকা।
তবু কি তার মাথায়
শব্দহীন পা রাখেনা ছোট্ট পিপীলিকা?
৭২. অণুসঙ্গী
তুমি যদি সন্ধ্যা হও,
আমি হবো ‘ব্যস্ত ঘরে ফেরা’।
তুমি সেই মোৎসার্ট,
আমি যার একান্ত অপেরা।
৭৩. দানব
শস্যের কাছে― পিঁপড়ে।
পিঁপড়ের কাছে― আমি।
আমার কাছে―’ আমার, আমি হয়ে থাকা’।
আরও পড়ুন- শ্রীজাত এর অণুকবিতা