পলাশ মজুমদার এর গল্প- অভিমান
বেসরকারি একটি সংস্থার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাজশাহীতে যোগদানের কয়েক দিনের মধ্যে লোকটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, তা-ও বছর পাঁচেক আগের কথা। আমি তখন থাকতাম সাহেববাজারে। একটি পরিবারের সঙ্গে সাবলেটে। কিছুদিনের জন্য রাজশাহী যাচ্ছি বলে পরিবার সঙ্গে নিয়ে যাইনি; আমার স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকত ঢাকায়।
বাসা ছিল অফিসের কাছাকাছি। একা থাকতাম বলে অফিসের পর বাসায় ফেরার তাড়া থাকত না। শহরে আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান ছিল পদ্মার পাড়। কেন জানি সেখানে গেলে ভালো হয়ে যেত মনটা। কাজ না থাকলেও চলে যেতাম। সময় কাটাতাম নদীর দিকে তাকিয়ে। নদী আমার বরাবরই ভালো লাগে। শেষ বিকেলে হাঁটতে বের হতাম মূলত পদ্মার আকর্ষণে; প্রেয়সীর মতো মায়াবী পদ্মা যেন আমাকে ডাকত হাতছানি দিয়ে। সে দিনগুলো আজও আমার স্মৃতিতে জাগরূক।
প্রায় খেয়াল করতাম, প্রবীণ এক ব্যক্তি বসে থাকতেন পার্কের বেঞ্চে। কখনো বন্ধ রাখতেন চোখ। আর কী যেন ভাবতেন আনমনে! হয়তো ভাবতেন ফেলে আসা দিনের কথা। কিংবা ফিরে তাকাতেন দীর্ঘ জীবনের দিকে; পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব করতেন। এক পা না থাকলেও লোকটিকে অসুখী মনে হতো না। কেমন যেন সুখী সুখী ভাব ছড়িয়ে থাকত মুখমণ্ডলে। অথচ দুই পা থাকা সত্ত্বেও আমি প্রায়ই বিমর্ষ থাকতাম। পৃথিবীর এমন কোনো বিষয় নেই, যেটার প্রতি আমার অভিযোগ ছিল না। বুঝতাম এটি একধরনের রোগ; কিন্তু নিরাময়ের উপায়ও জানা ছিল না।
বৃদ্ধের চেহারায় স্পষ্ট ছিল আভিজাত্যের ছাপ। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের বহিঃপ্রকাশ। এজন্য বয়স কাবু করতে পারেনি মানুষটিকে। চুল-দাড়ি সব সাদা হলেও শরীর ছিল বেশ সুঠাম। তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হতো কখনো কখনো। দুজনে মৃদু হাসি বিনিময় করতাম তখন। মনে হতো, কোথায় যেন তাকে দেখেছি; কিন্তু কোথায় দেখেছি, তা মনে পড়ত না।
এক বৈকালিক ভ্রমণের সময় উপযাজক হয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। তিনি নিজের সম্পর্কে প্রথমে কিছু বলেন না; একটু আড়ষ্ট ছিলেন। যখনই শুনলেন যে, আমার বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে, তখন তার মধ্যে লক্ষ করি পরিবর্তন। একটু নড়েচড়ে বসেন; আমার দিকে তাকান গভীর মনোযোগে। কৌতূহলী হয়ে জেনে নেন আমার কুষ্ঠি-ঠিকুজি।
আমার প্রতি তার আগ্রহ দেখে সন্দেহ জাগে। আমিও তাকে কিছু প্রশ্ন করি। একপর্যায়ে তিনি বলতে বাধ্য হন তার আদিনিবাসের কথা। বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে অবশেষে বললেন, তোমার বাবা ছিলেন আমার বন্ধু।
এবার তার চেহারা আমার স্মরণে আসে। দুইজন মানুষকে এক জায়গায় মেলাতে পারি। ছোটবেলার কথা মনে করে তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনার নাম রতন, তাই না?
তোমার বুঝি মনে আছে আমার কথা—তিনি আমাকে বললেন।
আবছা আবছা মনে আছে। তখন তো অনেক ছোট ছিলাম। আঙ্কেল, যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি?
অবশ্যই পারো। কী জানতে চাও—তিনি বললেন।
আপনি কেন বাড়ি ছাড়লেন? কী সমস্যা হয়েছিল তখন? যদিও বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন কথা শুনেছি। আপনার কথা বাবা-মা এখনো মাঝে মাঝে বলেন, আমি বললাম।
যাক। মনে রেখেছে তাহলে। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
বলুন না আপনার বাড়ি ছাড়ার কারণ কী ছিল?—আমি আবার প্রশ্ন করলাম।
সব বলব। তবে আজ নয়। আরেক দিন।—তিনি বললেন।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। বিদায় নিয়ে চলে এলাম। তবে মন থেকে তাকে কিছুতে মুছতে পারছিলাম না।
দুই.
অনেক দিন আগে আমাদের গ্রামের এক ব্যক্তি নিরুদ্দেশ হয়েছিল। আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে জমা আছে তার কথা। আমরা তাকে ডাকতাম রতন কাকু বলে।
মানুষটির ডান পা ছিল না। তার পায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বাবা বলতেন, যুদ্ধের সময় পা হারিয়েছেন তিনি। বিলোনিয়ার যুদ্ধে তার ডান পায়ে গুলি লাগে। পরে সেই পা অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয়েছিল। অবশ্য তাকে জিগ্যেস করে এই বিষয়ে কখনো কিছু জানতে পারিনি। নিজের ব্যাপারে তিনি বরাবরই ছিলেন নিরুত্তাপ।
কারও মুখে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকাররা তার নামে এই অপবাদ রটিয়েছিল যে, তিনি দেশ ছেড়ে-যাওয়া অনেক হিন্দুর সম্পদ দখল করেছেন; শাস্তি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধারাই কেটে দিয়েছিল তার পা; তিনি আসলে মুক্তিযোদ্ধা নন। তবে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে তার নামে কটুকথা বলতে শুনিনি; বরং মুক্তিযোদ্ধা বলেই স্বীকৃতি দিয়েছেন তাকে।
মুক্তিযোদ্ধা নয়, একজন মানুষের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রথম প্রথম এলাকাবাসীর কৌতূহল ছিল সীমাহীন। অনেকে আফসোস করত, কোথায় হারিয়ে গেল মানুষটা। অবশ্য গ্রামের মানুষের কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধার আলাদা কোনো মূল্য ছিল না। অন্য সব বিষয়ের মতো একসময় সবাই ভুলে যায় মানুষটির কথা।
আমাদের সঙ্গে তার একরকম পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন বাবার সহপাঠী। ছোটবেলার খেলার সাথি। আমার ছেলেবেলায় বাবার কাছে প্রায়ই আসতেন তিনি; গল্প-গুজবে মেতে সময় কাটাতেন। সেই আড্ডায় জড়ো হতেন তাদের আরও কয়েকজন বন্ধু; রতন কাকু থাকতেন আড্ডার মধ্যমণি। আমুদে লোক ছিলেন; বেশ মাতিয়ে রাখতে পারতেন পরিবেশ। এজন্য সবাই ভালোবাসত তাকে।
বাবা মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতেন তার বাড়িতে। দেখতাম, সারা ঘরে কেবল বই আর বই। কখনো দেখতাম তিনি পড়ছেন গভীর মনোযোগে। বাবার কাছে জেনেছিলাম, তার একমাত্র কাজ বই পড়া। টাকাপয়সার সমস্যা না থাকায় কিংবা তিনি একা বলে কোনো জীবিকা গ্রহণ করেননি। সেই বয়সেও আমার কাছে বই পড়ার দৃশ্যটি ভীষণ ভালো লাগত।
তিনি তখনও বিয়ে করেননি। অথচ বয়স হয়ে গিয়েছিল পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। তার চিরকৌমার্য নিয়ে অনেক কাহিনি মানুষের মুখে মুখে ছিল। কেন জানি, তাকে নিয়ে গল্প করতে মজা পেত অনেকে।
কেউ বলত, রাজাকাররা কেটে দিয়েছিল তার পুরুষাঙ্গ। অন্য কথাও বলত কেউ কেউ। সেখানে থাকত বাজে ইঙ্গিত, যা শুনে আমার অস্বস্তি হতো। আবার কেউ বলত, প্রেমের ব্যর্থতায় বিয়ে থা করেননি তিনি।
তার গ্রামত্যাগ নিয়েও অনেকে বিভিন্ন কথা বলত।
তিনি তেরো বছর বয়সী একটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন। সম্পত্তির কারণে তার ভাইয়েরা কৌশলে গায়েব করে ফেলে ছেলেটিকে। কারও ধারণা, ছেলে হারানোর বিষয়টা তাকে কষ্ট দিয়েছিল বলে তিনি আর গ্রামে থাকতে চাননি। ভাইয়েরা রটায় যে, ছেলেটির সঙ্গে তার গোপন সম্পর্ক ছিল; সেটা জানাজানি হওয়ায় তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন।
কেউ বিদ্রুপ করে বলত, পাপ ঢাকার জন্য তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। আসলে তিনি ছিলেন নপুংসক। সে জন্য বিয়ে করেননি। বিয়ে না-করা একজন পুরুষকে সমাজ কি ভালো চোখে দেখে? সমাজে থাকতে হলে সমাজের একজন হয়েই যে চলতে হবে।
কেউ বলত, তিনি ভেতরে ভেতরে নাস্তিক ছিলেন। তা না হলে নামাজ পড়তেন না কেন। একবার গ্রামের মাতব্বর সালিস ডেকে তাকে শুক্রবারে মসজিদে যেতে চাপ প্রয়োগ করেন। তার গ্রাম ছাড়ার পেছনে এটাও হয়তো একটি কারণ।
এমন আরও অনেক কথা আজও ভাসে আমাদের গ্রামের বাতাসে।
আরও পড়ুন- আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প- জলটুঙি
তিন.
ওই দিন পদ্মার পাড়ের বেঞ্চে বসে রতন কাকুর সঙ্গে আমার খুব বেশি কথা হয়নি। বিদায়কালে তিনি অনুরোধ করে বললেন, তার পূর্ব-ইতিহাস যেন আমি রাজশাহীর কাউকে না বলি; এমনকি আমাদের গ্রামের মানুষকেও তার এখানকার কোনো খবর না জানাই।
তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম, অবশ্যই।
পর মুহূর্তে তাকে বললাম, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার জীবনসংগ্রামের কাহিনি আমাকে বলতে পারেন। মানে কীভাবে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছেন।
তিনি বললেন, তুমি আগামী শুক্রবার সকাল দশটায় আমার বাড়ি এসো। তখন বলব সব।
ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে যাই আমি। বাড়িটি চিনতাম। ওই বাড়ির সামনে দিয়ে অনেকবার হেঁটেছি। তখন রাজপ্রাসাদতুল্য দৃষ্টিনন্দন বাড়িটির দিকে চোখ চলে যেত। চলার পথে রাস্তার মানুষজনকেও তাকিয়ে থাকতে দেখেছি।
আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে যান। নিচতলার ড্রয়িংরুমে বসার কিছুক্ষণের মধ্যে সামনে হাজির হয়ে যায় নানা পদের খাবার। বুঝতে পারি আমার জন্য আগেই তৈরি করে রাখা হয়েছে। কিংবা এমন অভিজাত পরিবারে এসব খাবার প্রস্তুত থাকে। তার পীড়াপীড়িতে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে বললাম—আঙ্কেল, আমি খেতে আসিনি। এসেছি শুধু আপনার গল্প শুনতে।
তিনি বললেন—আগে কিছু খেয়ে নাও। সারা দিন তো পড়ে আছে। তোমাকে পেয়ে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আজ ছাড়ছি না সহজে।
তার কণ্ঠে আন্তরিকতা আর আবেগ একসঙ্গে ঝরে পড়ছিল, যা মুহূর্তে স্পর্শ করে আমাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন ভালোবাসার মানুষের সংখ্যা কমে আসে। একদিন নাম ধরে ডাকার মানুষও থাকে না; স্নেহ তো অনেক দূরের বিষয়।
তারপর পুরো বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখালেন। কথায় কথায় জানালেন, তার স্ত্রী মারা গেছেন গত বছর। ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে। তাকে দেখাশোনা করে কাজের লোক আর কর্মচারীরা। ঘরে বসেই সবকিছু তদারক করেন তিনি।
তার বলা কথাগুলো রূপকথার মতো লাগে। এ যে আলাদিনের প্রদীপের কাহিনিকে হার মানানোর মতো ব্যাপার।
চার.
আমি যেদিন রাজশাহীর মাটিতে পা রাখি, পকেটে একটি টাকাও ছিল না। এদিকে খিদায় চোঁ চোঁ করছিল পেট। বাড়ি ছাড়ার পর প্রথমে ভেবেছিলাম, ঢাকায় আত্মগোপন করে থাকব। পরক্ষণে ভাবলাম, এমন কোথাও চলে যেতে হবে, যেখানে কেউ চিনবে না। এ-রকম চিন্তা থেকে চেপে বসেছিলাম রাজশাহীর ট্রেনে।
ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের পাশের একটি রেস্টুরেন্টের মালিককে অনুরোধ করে বললাম, আপনি যদি থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে একটি কাজ দেন, আমি তা করব; কোনো টাকা দিতে হবে না।
আমাকে আপাদমস্তক দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ কাজের ব্যবস্থা করে দেন।
ভদ্রলোকের নাম ছিল ওসমান গনি চৌধুরী। রাজশাহীর স্থানীয় লোক। আমার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট হবেন হয়তো।
কিছুদিন পর তিনি আমাকে ক্যাশে বসতে দেন; লক্ষ টাকার চেক দিয়ে টাকা তোলার জন্য পাঠান ব্যাংকে। দিন দিন আমি তার বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠি। আমার মধ্যেও প্রকাশ পায় স্বাভাবিকতা। একসময় পরিবারটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই।
আমার রাজশাহীতে আসার বছরখানেক পর পুঠিয়ার কাছে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ওসমান গনি চৌধুরী মারাত্মক জখম হন; তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
মারা যাওয়ার সময় গনি সাহেব আমার হাত ধরে অনুরোধ করেন, বাচ্চাগুলোকে আপনি দেখে রাখবেন; তারা স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত ওদের অভিভাবক হয়ে আপনি তত্ত্বাবধান করবেন আমার বিষয়-আশয়। তার স্ত্রীর সম্মতি নিয়ে আরও অনুরোধ করেন, আমার কিছু হয়ে গেলে আপনি আমার স্ত্রীকে বিয়ে করবেন।
তাকে আমি কথা দিয়েছিলাম।
এরপর থেকে আমার সমস্ত মনোযোগ ছিল ব্যবসায়ে। ঠিকভাবে ঘুম পর্যন্ত যেতাম না। ব্যবসা বাড়াতে বাড়াতে গড়ে তুললাম চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। অল্প সময়ে ব্যবসা অবিশ্বাস্য রকম সম্প্রসারিত হয়। আমার সততার সুনাম এত ছড়িয়েছিল যে, রাজশাহী শহরের ব্যাংকের ম্যানেজাররা একরকম জামানতহীন ঋণ দিয়ে আমার পাশে দাঁড়ান। তাদের সহযোগিতা না পেলে এত দূর হয়তো আসতে পারতাম না।
পাঁচ.
রাজশাহী শহরে ‘রতন চৌধুরী’ এক নামে পরিচিত। তাকে চেনে না, এখানে এমন মানুষ খুব কম। চিনতেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। ফুল ফুটলে সুবাস ছড়াবেই, তা বনের যত গভীরে ফুটুক না কেন। একজন মুক্তমনা পরিচ্ছন্ন মনের আলোকিত মানুষ হিসেবে শহরবাসী তাকে দেখত শ্রদ্ধার চোখে।
তিনি হিন্দু না মুসলমান, এখানকার কেউ জানত না; কারণ ‘রতন চৌধুরী’ নাম দেখে তা বোঝার উপায় নেই। ধর্মীয় পরিচয়ের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিতেন না। কখনো বলতেন, আমি একজন মানুষ। এটাই আমার পরিচয়।
তিনি মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় কখনো যেতেন না। এমনকি দান করতেন না কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। কেবল দাতব্য ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিতেন। তিনি যে সৎ মানুষ, এই ব্যাপারে কারও সন্দেহ ছিল না।
ছয়.
সেদিনের পর থেকে দুজন একই সময়ে হাঁটতে বের হতাম। প্রায় প্রতিদিন দেখা হতো আমাদের। নানা বিষয়ে কথা হতো। আড্ডায় আড্ডায় অসম বয়সী দুজন মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে চমৎকার বন্ধুত্ব। আলাপে বেশি থাকত তার ফেলে আসা দিনের কথা। একটা প্রসঙ্গ একবার উঠলে সহজে তিনি শেষ করতে চাইতেন না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেবল শুনতাম।
ছয় মাসের মাথায় হঠাৎ আমার বদলির অর্ডার হয়ে যায়। আবার ফিরতে হবে ঢাকায়। হেড অফিসে। রতন কাকুকে এই কথা জানানোর পর গম্ভীর হয়ে যান তিনি।
এই অবস্থায় কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই।
তিনি তা বুঝতে পেরে স্মিত হাসলেন—তুমি দেখছি তোমার বাবার মতো।
মনের মধ্যে ঘুরপাক খেলেও এত দিন যে প্রশ্নটি করার সাহস পাইনি, বিদায়কালে তা করে বসলাম—আঙ্কেল, আপনার কি একবারও জন্মভিটায় যেতে ইচ্ছে করে না?
সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ মলিন হয়ে ওঠে। কী ভেবে যেন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন—বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলছে, তা মরলেও নিভবে না।
তার প্রতিটি কথায় ঝরে পড়ে আবেগ। তাকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, আপনাকে তো সবাই সফল মানুষ হিসেবে জানে। কী নেই আপনার? সবই তো পেয়েছেন এক জীবনে।
আমার মুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকেন তিনি। কোনো কথা বলেন না। চোখের কোণে চিকচিক করে অশ্রু। আমি আবার প্রশ্ন করলাম—আঙ্কেল, আপনি কি আসলে ভালো নেই?
এবারও তিনি নিরুত্তর।
আরও পড়ুন- অনামিকা হক লিলি’র গল্প- আক্রোশ