পারস্য প্রতিভা- বই রিভিউ- রুশিয়া জামান রত্না
গ্রন্থের নাম: পারস্য প্রতিভা
গ্রন্থের ধরন: প্রবন্ধ
লেখক: মোহম্মদ বরকতুল্লাহ
প্রকাশনা সাল: ১ম খন্ড ১৯২৪, ২য় খন্ড ১৯৩২
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কর্তৃক সংস্করণ : ১৯৯৪
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রচ্ছদ মূল্য: ১৬০/- টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১৩
ISBN: 984-18-0117-5
ভূমিকা:
বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে বিংশ শতাব্দীর যে গুটি কয়েকজন লেখক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাঁদের অন্যতম মোহম্মদ বরকতুল্লাহ। সাবললী ও প্রাঞ্জল শব্দ প্রয়োগে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও মাত্র একটি গ্রন্থই তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অমরত্বের স্থান দিয়েছে আর তা হলো বিখ্যাত প্রবন্ধ গ্রন্থ “পারস্য প্রতিভা”। মোট দুটি খন্ডে রচিত হয় গ্রন্থটি। পারস্য দেশের ইতিহাস, সাহিত্যের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট এবং পারস্য দেশে জন্মগ্রহণকারী প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের জীবন ও কর্ম নিয়েই মূলত গ্রন্থটি রচিত। কিন্তু এ গ্রন্থের ভাষা ও মাধুর্য পাঠকে উপন্যাস পড়ার মতো অনুভব করাবে। দুটি খন্ডকে একত্র করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় বহুল পঠিত ও সমাদৃত এই গ্রন্থটি যার ভূমিকা লিখলছেন শহিদুল আলম।
লেখক পরিচিতি:
বাংলা গদ্য সাহিত্যে মুসলমানদের আবির্ভাব -লগ্নে যে কয়জন মুসলিম লেখক স্বীয় প্রতিভাবলে বাংলা গদ্য সাহিত্যের আসরে নিজেদেরকে স্বায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন তাদের অন্যতম মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ। মোহম্মদ বরকতুল্লাহ ১৮৯৮ সালের ২রা মার্চ সিরাজগঞ্জ জেলার ঘোড়াশালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজী আজম আলী ছিলেন একজন কবিরাজি চিকিৎসক এবং মাতা তসিরন বিবি ছিলেন গৃহিণী। শৈশব থেকেই মোহম্মদ বরকতুল্লাহ মেধার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন। শাহজাদপুর হাই ইংলিশ স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে বৃত্তি নিয়ে ম্যাট্রিক (বর্তমানে এসএসসি) পাশ করেন। পরবর্তী সময়ে রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯১৬ সালে প্রথম বিভাবে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯১৮ সালে দর্শনে অনার্স নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে বিএ পাশ করেন। ১৯২০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে এমএ পাশ করেন এবং ১৯২২ সালে ল’ পাশ করে পরবর্তী বছরে ওকালতির সনদ লাভ করেন।
চাকরি জীবন শুরু করেন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার হিসেবে। কিন্তু সেখানে খাপ খাওয়াতে না পেরে পরের বছর বিসিএস প্রশাসনে যোগদান করেন। অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জায়গায় তিনি দায়িত্ব পালন করেন ম্যাজিস্ট্রেট, এসডিও, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং জেলা প্রশাসক হিসেবে। ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হলে বিশেষ কর্মকর্তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ গুলোর মধ্যে অন্যতম “পারস্য প্রতিভা” (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড) মানুষের ধর্ম, নবীগৃহ সংবাদ, কারবালা ইত্যাদি ।
গ্রন্থ পর্যালোচনা:
বাঙালি মুসলিম জাগরণের মুখে চিন্তাশীল প্রবন্ধকার হিসেবে “পারস্য প্রতিভা” গ্রন্থটি নিয়ে হাজির হোন ঋদ্ধ লেখক মোহম্মদ বরকতুল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার ‘বিদগ্ধ’ সমাজ তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বরণ করে নিয়েছিলেন। সেকালের অনেক কট্টর সমালোচকও গ্রন্থটির প্রশংসা করেছেন এবং গ্রন্থটি তাদেরকে আলোরিত করেছিল বৈ কি। “পারস্য প্রতিভা” ইরানের ধ্রুপদী সাহিত্যের বস্তুনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী রচনা তো বটেই এই গ্রন্থের সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর ভাষা ও রচনা কৌশল। ভাষার মাধুর্য, বর্ণনা- চাতুর্যে ও ভাবের -প্রাচুর্যে এই বইটি যেমন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তেমনি মোহাম্মদ বরকাতুল্লাহ বইটি রচনার মাধ্যমে নিজের পাণ্ডিত্যও প্রকাশ করেছিলেন। প্রাঞ্জল সাবলীল এবং আবেগময় বাক্যের ব্যবহার বইটিকে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে এবং সব শ্রেণী পেশার পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছে। গ্রন্থটি মোট দুইটি খন্ডে প্রকাশিত হয়। দুই খন্ডে কবি-সাহিত্যিকের জীবন ফুটে উঠেছে এবং শুরুর দিকে পারস্য (বর্তমান ইরান) এবং ইরানের সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
“সাহিত্যের ইতিহাসও যে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে মোহম্মদ বরকতউল্লাহ-র পারস্য প্রতিভা যেন তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ” বইটি সম্পর্কে এমনই মন্তব্য করেছেন বইটির ভূমিকা লেখক শহিদুল আলম।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ১৯৯৪ সালে দুই খণ্ডকে একত্র করে সংস্করণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। পারস্য ও পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস এবং ৬ জন বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে নতুন এ সংস্করণটি প্রকাশিত হয়। মোট ১১৩ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটিতে পারস্য -সাহিত্য, কবি ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদী, কবি হাফেজ, জালাল উদ্দিন রুমি এবং ফরিদউদ্দিন আত্তার নিয়ে মোট সাতটি প্রবন্ধ উপস্থিত।
বইটি সম্পর্কে ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন লেখককে লেখা এক চিঠিতে জানান,
“আপনার প্রবন্ধ গ্রন্থটির গদ্যরীতি এতই চমৎকার যে আমি এটি পাঠ করতে গিয়ে উপন্যাস পাঠের আনন্দ পেয়েছি “। প্রকৃতপক্ষে, পারস্য সাহিত্যের প্রতি লেখকের ভালোবাসা ও আবেগ প্রতিটি পাতায় ফুটে উঠেছে। এমনকি যাঁদের জীবন ও সাহিত্যকর্ম তিনি উপস্থাপন করেছেন তাদের প্রতি লেখকের সীমাহীন সম্মান ও শ্রদ্ধা কোন রাখঢাক না রেখেই তুলে এনেছেন। এটি লিখতে গিয়ে তাঁকেও যে বহু পরিশ্রম করতে হয়েছে তা দৃশ্যমান। কবিদের জীবন কাহিনীর মামুলি বর্ণনা দিয়েই গতানুগতিক ধারায় তিনি বইটি শেষ করেননি। ঐ সাহিত্যিক সম্পর্কে বিজ্ঞজনের উক্তি, মতামত, উল্লেখযোগ্য কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে তার মর্মার্থও পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রয়াস নিয়েছেন। যেমন–
“কবি ফেরদৌসী” শিরোনামের প্রবন্ধ শুরু করেছেন Sir William Jones এর একটি মন্তব্য দিয়ে, ” Shahnama is glorious monument of eastern genius and learning which if ever it should be generally understood in its original language, will contest the merit of invention with Homer himself”
পৃষ্ঠা- ১৯
লক্ষ্যণীয় যে, ফারসি ভাষাকে বাংলা হরফে লেখার একটি প্রয়াস পুরো বইটি জুরে ছিল। যেমন-
“গোইয়ান্দ ম’রা চুঁ সুর বা হুশ খোশ আস্ত
মান মী গোফত কে আবে আঙ্গুর খোশ আস্ত”৷
— “তারা বলে সুখ স্বর্গের হুরে
আমি বলি সুখ এই মদিরে বঁধু”
পৃষ্ঠা- ৫২
সাহিত্যকের জীবনের নাটকীয় ঘটনা রূঢ় কঠিন বা রসহীন ভাষায় না লিখে সেখানে কলা সাহিত্যের রস ও মাধুরতা দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। পাঠককে উপন্যাসের আনন্দ দিতে সাহিত্যকদের জীবনকে গল্প বা উপন্যাসের ঢঙে রংয়ে এঁকেছেন। নায়ক হিসেবে উপস্থিত করেছেন খোদ সাহিত্যিক/কবি-কে।
লেখক মোহম্মদ বরকতুল্লাহ তাঁর অভূতপূর্ব মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন এই গ্রন্থে। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ও জানাশোনা মেলে ধরেছেন প্রতিটি প্রবন্ধে। আফসোস করেছেন তৎকালীন সময়ের পারস্য সাহিত্য নিয়েই। স্পষ্টভাবে বলেছেন, সেই ধ্রুপদী সাহিত্যের মান বর্তমান সময়ের সাহিত্যিকরা ধরে রাখতে পারছে না। পারস্য সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই যে এ অনুরাগের হেতু তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে লেখক আধাত্মিক ভাবধারা বা সুফিবাদের অবতারণা করেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে যাতে গ্রন্থটির বিষয়বস্তু স্থানচ্যুত না হয়। রুমি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন–
” কবি হিসেবে বলো, দার্শনিক হিসেবে বলো, আর সিদ্ধতপা সাধক হিসেবেই বলো সকল বিভাগেই ইনি অতি উচ্চ আসন অধিকার করিয়া আছেন।
পৃষ্ঠা- ৮৭
শেষ কথা:
সাধু ভাষায় রচিত হলেও লেখক তাঁর লেখার প্রতি এতটাই যত্নশীল ও সজাগ ছিলেন যে পাঠকের কাছে গ্রন্থটি দূরবোধ্য তো নই বরং সুখপাঠ্য হিসেবে স্বীকৃত। সাহিত্যিকদের জীবনও যে এত চমৎকার সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে মোহম্মদ বরকতুল্লাহর আগে এমনটা কেউই ভাবতেও পারেননি। তার শক্তিশালী লেখার হাত গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে অনন্য স্থান দিয়েছে এবং তাঁকে দিয়েছে গদ্য শিল্পীর মর্যাদা। তাই হরিদাস ভট্টাচার্যের মত করে বলতে হয়,
“যে সকল লেখক বঙ্গসাহিত্যকে স্বাবলম্বী হইতে সহায়তা করিয়াছেন পারস্য প্রতিভার লেখক মোহম্মদ বরকাতুল্লাহ তাদের অন্যতম”।
*রিভিউ লেখক: রুশিয়া জামান রত্না- সমাজসেবা অফিসার।