প্রাচ্যের সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ে একটি বিবেচনা- অনুবাদ: কাজী একরাম
দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর, ঊনবিংশ শতাব্দীতে টিকে থাকা যৌন নৈতিকতার শেষ খুঁটিগুলিও নড়বড়ে হয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। এই পতনোন্মুখ বিপর্যয়কে পশ্চিমা দেশগুলোর নেতা, দার্শনিক, শিক্ষকগণ ‘নতুন নৈতিকতা’ অভিধায় মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেন! জনৈক পশ্চিমা পণ্ডিতের ভাষায়, ‘ইউরোপ-আমেরিকায় যা ঘটছে, তাকে যদি নতুন নৈতিকতা বলে ব্যাখ্যা করা হয়, তবে চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচায় প্রতিদিন এমন নতুন নতুন নীতি-নৈতিকতা জন্ম নেয়।’
আজকাল শিল্পীরা এমন শিল্প তৈরি করেন যা জনমানুষের যৌন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে তুষ্ট করে। সাহিত্যকে জীবনের চিত্র বলে লেখকরা জীবন থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকেন, যাতে তারা প্রগতির দার্শনিক ও যৌন বিপ্লবের সারথী হিসেবে গণ্য হতে পারেন। মানুষ যেন এক ভয়ানক গোপন বেদনার গহ্বরে হাবুডুব খাচ্ছে, যার প্রতিকার মনের সে তৃপ্তি যা যৌন নৈতিকতা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে পাওয়া যায়! সিনেমা, আর্ট, নভেল এবং পত্রিকা-ম্যাগাজিন সেই আকাঙ্ক্ষার চিত্রগুলিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে অথবা ‘তথ্য’ হিসেবে উপস্থাপন করে তারা, যাতে পাবলিকের যৌন আকাঙ্খার তুষ্টিবিধান হয়।
প্রাচ্যে, পাশ্চাত্য শিল্প ও সাহিত্যের নকলের প্রচেষ্টায়, অগ্রহণযোগ্য টেকনিক প্রয়োগের নেশায়, এক কিম্ভূতকিমাকার টাইপের শৈল্পিক-সাহিত্যিক কাকড়া তৈরি করা হয়। সুররিয়ালিজম, ইম্প্রেশনিজম এবং অনেক পশ্চিমা ইজমকে সাহিত্যে ও শিল্পে নিছক অনুকৃতি হিসেবে আমদানি করা হয়। অনেক সময় আমাদের লেখকরা বোঝানোর চেষ্টা করেন, পশ্চিমা সাহিত্যের ধারণা এবং দাবিই আমাদের সমাজের ধারণা এবং দাবি। আমাদের সমাজের যদি পশ্চিমা জীবন থেকে কিছুটা ভিন্নতা থাকে, তবে তারা নিজের সমাজের ‘নীচতা’ নিয়ে ‘দার্শনিক অবজ্ঞা’ প্রকাশ করেন। আদতে পাশ্চাত্য সাহিত্যের নকলকরণ লকবলাভের একটি প্রচেষ্টা, যাকে প্রগতিবাদের একটি দিক বিবেচনা করা হয়। কিসের প্রগতি? পশ্চিমি এবং সমাজতন্ত্রী সাহিত্যের নকলের প্রগতি! সিনেমা, রেডিও, উপন্যাস, পত্রিকার ফটো এবং বিজ্ঞাপনে প্রতিদিন যৌন বিষয়ের রমরমা পুনরাবৃত্তি চলে। তৃষ্ণার্ত ঠোঁট মরীচিকায় মন ভোলায়। শিল্প-কলায় জীবনের মিথ্যা প্রচ্ছায়া প্রতিবিম্বিত করার চেষ্টা চলে। যৌনতা সবসময় শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত ছিল বটে, কিন্তু এই মহামারী পরিস্থিতি কখনও ছিল না।
এর পর, শিল্প-সাহিত্যে বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের নামে যৌন-উশৃঙ্খলাকে চিকিৎসাশাস্ত্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত এই কাজের শ্রেষ্ঠ ‘পয়গম্বর’ হলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড, যার ‘মনোসমীক্ষণ’কে (Psychoanalysis) ইউরোপের আধুনিক যুগ ‘পবিত্রগ্রন্থ’ জ্ঞান করে থাকে। ফ্রয়েডের মতে, যৌন সংযম উদ্বেগ এবং হতাশার কারণ। স্নায়বিক রোগ (Neurosis) হলো যৌন তৃপ্তি না-পাওয়ার অপরিহার্য ফল। স্নায়বিক ব্যাধির ভিত্তি হলো সেসব বিপত্তি, যা পরিস্থিতি বা সমাজের নিয়মনীতির আকারে যৌনতৃপ্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহ এবং নৈতিকতা এই ক্ষেত্রে স্নায়বিক স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় শত্রু! নৈতিক নীতির বিনাশের মাধ্যমেই মনস্তাত্ত্বিক স্বর্গের পথ সুগম হয়। এইভাবে, বিজ্ঞান এবং মনোরোগবিদ্যা হয়ে উঠে অনৈতিকতা ও যৌন-নৈরাজ্যের ন্যায্যতা।
ফ্রয়েডের মতে, নিউরোসিস যৌন-সংযমের কারণে সৃষ্টি হয়। যৌন শৃঙ্খলাহীনতা হলো স্বাস্থ্য আর এর প্রত্যাখ্যান হলো রোগ এবং মৃত্যু। এটা সম্ভব যে, ফ্রয়েড তার জন্মভূমি ভিয়েনায় এমন যৌন পরিস্থিতি দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন যে, তার পর্যবেক্ষণ এবং ভাবনা এ ধরনের সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে পারে! তার ব্যাখ্যায়, মানুষ মানে যৌনতা। যৌনতা মানে মানুষ। শিল্প, উদ্ভাবন, দর্শন, তার মতে যৌনতার সাব্লিমেশন। ফ্রয়েডের মতে, বন্ধুত্ব এবং পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা যৌনতারই একটি দিক।
ফ্রয়েড সমস্ত স্নায়ু-ব্যবস্থাকে যৌনতা বলে মনে করেন। অথচ যৌনতা স্নায়ু-ব্যবস্থার একটি মাত্র দিক। প্রকৃতির প্রতিটি প্রয়োজনেই অতিরিক্ত সংযম ও বিপত্তি, যেমন খাবার না দেওয়া, ঘুমাতে না দেওয়া, জোরপূর্বক দেখা বা শোনা থেকে বঞ্চিত করা, এ-সবই স্নায়ুরোগের কারণ হতে পারে। যে প্রশ্নটি উঠে তা হলো, একজন ব্যক্তি কি আত্মবিকাশের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের সেই উচ্চস্তরে পৌঁছাতে পারে না, যেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ আত্ম-ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় এবং হতাশা তৈরি করে? অভিভাবকদের ভেটো, শিক্ষকদের শিক্ষার জন্য বাধ্য করা, অন্য মানুষের প্রতি সম্মানের বাধ্যবাধকতা, আত্ম-শৃঙ্খলার তিক্ততা এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। হিটলারের আক্রমণের সময়, ইংরেজ বিমানসেনারা তাদের দেশের নিরাপত্তার জন্য আত্মহত্যার সীমা পর্যন্ত আত্মত্যাগ করার শপথ করেছিল। হিটলার ইংল্যান্ডে বিমান হামলায় পরাজিত হয়েছিল। প্রতিটি মহত্ত্বকে যৌনতার সাব্লিমেশন বলা সঠিক মনোবিশ্লেষণ নয়, বরং তা হবে EXOMANIA তথা যৌন উন্মাদনা। ক্ষুধার্ত মানুষের চাঁদ-সূর্যকে রুটি বলে মনে হয়, যাকে কিনা তাকে ক্ষুধার্ত রাখার জন্য শত্রুরা আকাশের উপর নিক্ষেপ করেছে! হ্যাঁ, মানুষের মৌলিক প্রবৃতি পশুত্ব, কিন্তু মানুষ একটি উচ্চতর ব্যক্তিত্বও তৈরি করেছে, যার কারণে সে পশুপ্রকৃতির কাছে একেবারেই অসহায় নয়। এই উচ্চ ব্যক্তিত্বও প্রকৃতির একটি বিবর্তিত রূপ এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, দৃষ্টান্ত এবং ঐতিহ্যের দ্বারা একে আরও সুদৃঢ় এবং শক্তিশালী করা যেতে পারে।
মানুষের মধ্যে মহত্ত্বের আকাঙ্ক্ষা যৌনতার মতো একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। যখন মানুষের আত্মা উচ্চতার দিকে ধাবিত হয়, তখন যৌন তাগাদাগুলি স্বত্বই দুর্বল হয়ে পড়ে। ইসলাম হলো মানুষের রুহানী সাবালকত্ব ও আত্মিক উৎকর্ষের নাম। যেমন প্রতিটি ব্যবস্থার আগে বিশৃঙ্খলা ছিল, যার পরিবর্তিত রূপটি হলো ব্যবস্থা, তেমনি উচ্চ প্রকৃতির আগে তুচ্ছ প্রকৃতি ছিল, যা উচ্চতর প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত, এবং প্রতিটি বালকত্বের ভিত্তি হলো শৈশব ও বাল্যকাল। সিগমুন্ড ফ্রয়েড যদি মানুষের পশুগত ভিত্তিকে স্পষ্ট করে, তবে এর দ্বারা এই ভিত্তির উপর মানবতার মোহনীয় স্থাপনা নির্মাণের ন্যায্যতা এবং প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায় না। ইসলাম উচ্চতর উদ্দেশ্যে যৌন আকাঙ্ক্ষার সুশৃঙ্খল পরিপূর্ণতার আদেশ দেয়। মূলত, প্রাণী হওয়া মানুষের ‘মানুষ না হওয়া’ প্রমাণ করে না। অথচ আমাদের অনেক লেখক-সাহিত্যিক সাহিত্যে মানুষের অবস্থার উন্নতি করার পরিবর্তে পাশ্চাত্যের ব্যাধিগ্রস্ত এবং পতিত অবস্থার স্তুতি-কীর্তন ও অনুকরণ করতে ব্যস্ত।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড পশ্চিমা মননে ফ্রাস্ট্রেশন বা নৈরাশ্য ও বঞ্চনার অনুভূতির ভয় পুঁতে দিয়েছেন। এই ফ্রাস্ট্রেশন প্রতিটি অযৌক্তিক যৌন আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তিবিধান করে দূর করা যেতে পারে, কিন্তু এই ধরনের তৃপ্তি মানুষের উচ্চতর ব্যক্তিত্ব এবং উচ্চতর প্রকৃতির জন্য অনিঃশ্বেষ ফ্রাস্ট্রেশনের উৎস হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ম্যাকবেথের হতাশা দূর করার জন্য ডানকানের হত্যার ন্যায্যতা জ্ঞান করার কোনো মানে হয় না। মানবীয় বৃত্তির নিছক আকাঙ্খা এবং হতাশা ছাড়া অারও দিক রয়েছে যার যথাযথ প্রশিক্ষণে মানুষের পার্থিব জীবন এক সুশৃঙ্খল সুখ হয়ে উঠতে পারে।
জীবনের প্রতিটি আকাঙ্খা পূর্ণ হতে পারে না। এই অর্থে, সমস্ত জীবন একটি দীর্ঘায়িত ফ্রাস্ট্রেশন। আকাঙ্খার পরিধি যুক্তিসঙ্গততা এবং সম্ভাবনার সীমার চেয়ে বিস্তৃত। তদুপরি অবচেতনের অরণ্যে অনেক ভয়ংকর বিপদাপদ তো রয়েছেই। কিন্তু মানুষের মানসিক বিবর্তন পশুপ্রকৃতি বা অবচেতন থেকে যুক্তি ও চেতনার স্তরে এজন্য উন্নীত হয়েছে, কারণ আবেগ-আকাঙ্খাকে সংযত ও সংগঠিত করার মাধ্যমে অধিকতরো আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা যেতে পারে এবং আবেগের নিয়ন্ত্রণ ও সংগঠন মানবীয় অস্তিত্ব এবং সমষ্টিগত জীবনের সৌন্দর্যের জন্য ছিল অপরিহার্য। এমনকি উচ্চ প্রকৃতির দাবিও এটা ছিল। প্রতিটি যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা বা বঞ্চিত হয়ে উন্মাদ বা বিদ্রোহী হয়ে যাওয়া একটি মনস্তাত্ত্বিক স্তর; যা থেকে মানুষ অগ্রগতি করেছে, কিন্তু পাশ্চাত্য যৌন জীবন ও সাহিত্যে সেই প্রাক-পরিপক্ক মানবতাকে কণ্ঠ দিতে ব্যতিব্যস্ত।
আজকাল, প্রাচ্যের কিছু সাহিত্যিক সাহিত্য ও শিল্পের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিত্বকে পশ্চিমের অনুকরণে আবার অপরিণত ও নাবালক বানানোর নির্বোধ চেষ্টা করছেন! সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ব্যাখ্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে যদি আমরা যৌক্তিকতা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও ধর্মকে উপেক্ষা করি, তবুও আমাদের উচ্চতর ব্যক্তিত্ব এক ধরনের ফ্রাস্ট্রেশন অনুভব করবে। এছাড়াও, ক্ষমতার উপাদানগুলি পশ্চিমি যৌনধারণা গ্রহণ করে লাভ করা যায় না।
ইউরোপীয় সাহিত্য সিগমুন্ড ফ্রয়েড দ্বারা প্রভাবিত কারণ, ফ্রয়েড পাশ্চাত্যের সাধারণ জীবন এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রদান করেছে, কিন্তু যদি তার ফলাফলগুলিকে প্রাচ্যের চিন্তাবিদরা যথেষ্ট গভীরভাবে বিবেচনা করেন, তাহলে এই দর্শনটি ইসলামি যৌন নৈতিকতা এবং আচরণের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক ন্যায্যতা হয়ে উঠতে পারে। সাহিত্য যদি উন্নত জীবনের পথ দেখায়, তবে প্রাচ্যের লেখকরা সেই উচ্চ ব্যক্তিত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন, যা প্রকৃতিগতভাবে আশরাফুল মাখলুকাতের প্রতিটি ব্যক্তির মানসিকতায় নিহিত রয়েছে। এবং সেই উচ্চ সমাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে যা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং মানবিক আবেগের যুক্তিসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ ও সংগঠন দ্বারা তৈরি করা যেতে পারে। কারণ, ফ্রয়েড ব্যক্তির সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করতে যেয়ে সমাজের বাকি অংশের অধিকার এবং তাদের সন্তুষ্টিকে উপেক্ষা করে যায়, যা একটি ধ্বংসাত্মক চিন্তাপদ্ধতি এবং যা যৌথ জীবনে অবাস্তব ও অকার্যকর।
ফ্রয়েড হলো পাশ্চাত্য জীবনে আত্মদর্শনের কেন্দ্র এবং দেখা যায় পশ্চিমা সাহিত্য ও শিল্প তাঁর দ্বারা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত। কিন্তু প্রাচ্যের সাহিত্য, প্রাচ্যের জীবন বিশ্লেষণ না করেই কেবল পাশ্চাত্যের সাহিত্য আন্দোলনসমূহের নিতান্তই ধ্বজাধারীর দায়িত্ব পালন করছে এবং এভাবে সৌন্দর্য সৃষ্টির মাঝে পশ্চিমা জীবনের স্তুতিকীর্তন করছে। ফ্রয়েডের বরাতে যৌনতার প্রোপাগাণ্ডা নিছক শক্তি-উপকরণের মধ্যে পশ্চিমের বর্তমান শ্রেষ্ঠত্ববোধ দ্বারা প্রাচ্যে সৃষ্টি হওয়া হীনম্মন্যতার অন্যতম ফল। প্রাচ্যের লেখকদের সমীচীন হলো তারা আরও স্ব-মুখী হবেন। তাদের এই সত্যবিস্মৃতি মোটেই উচিত হবে না যে, পশ্চিম হলো ছয়টি দিকের এক দিক মাত্র এবং পশ্চিমের কাছে নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে, প্রাচ্যকে শক্তির উপাদানলাভে কোনো সাহায্য করা যেতে পারে না।
*মূল লেখা- সৈয়দ মুহাম্মদ জামীল ওয়াস্তি এম.এ
আরও পড়ুন- কাজী একরামের প্রবন্ধ