“বিপ্লব” একটি পাখির নাম- শাশ্বত বোসের গল্প
দিনের এই সময়টা, বেশ একটা মধ্যবর্তী ভাব রেখে, চলে যায়, মনের কোণে, এক আখর বিন্যাসী মেঘ জমতে চাওয়া, নিঃসঙ্গ সন্ধ্যের পূর্বরাগে| জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখতে, কেমন যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায় ছেলেটার| প্রবল গ্রীষ্মের বহ্নিশিখা, বাইরেটা পুড়িয়ে ঝাপসা করে দিয়েছে একেবারে| চেতলার এই পুরোনো বাড়িটার, মেঝে ছুঁতে চাওয়া, জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে, উঁকি মারছে, পিছনের বাগানের মেহগনী গাছটা| গাছে সবে নতুন পাতা আসতে শুরু করেছে| ছেলেটি দেখেছে, প্রতি শীতের কোন এক নির্লিপ্ত কালবেলায়, গাছটার সব পাতা ঝরে যায়| খুব ভোরের চোখ কচলানো দৃষ্টিতে, সে দেখেছে গাছটার ছায়া, ছোট হয় এ সময়| আবার ঠিক পোয়াতি বসন্তে, দখিনা বাতাসে দোল দিয়ে, নতুন প্রাণ আসে গাছটায়| তার পেলভিস নিঃসৃত কামরস বেয়ে, শুরু হয় সারিবদ্ধ পিঁপড়ের আনাগোনা| ছোট্ট চড়াইদুটো, বাসা থেকে বেরোয়| ক্রমশঃ বাড়তে থাকা, মোবাইল টাওয়ারের, বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়াকে দুয়ো দেখিয়ে, গাছটা থেকে আকাশে ঝাঁপ মারে, শতাব্দী শোক ভেঙে উড়ে যায়, নরম জীবনের সন্ধানে| ঠিক যেমন, আজ থেকে বছর তিনেক আগে, ছেলেটা জামবনি থেকে কলকাতায় এসেছিলো, কোন এক বৈরাগী বিকেলের শুরুতে, কোন ভালো নাটকের দলের অংশ হতে| সেই শুরুর দিন থেকে, প্রতিটি সন্ধ্যে সে কাটিয়েছে, কল্লোলিনীর শরীরে উত্তাপ ছড়ানো, চায়ের স্টোভের গলনাঙ্কে ফুটতে চেয়ে| সারাদিন রিহার্সালে, নাটকের দলের ব্যস্ত তারকার, প্রক্সি দেবার পর সে ফিরত, এই তেতলার অন্ধকার ছাতের ঘরটায়| দেশ কালের সীমানা ছিড়তে চাওয়া, ঘুলঘুলির ফাঁকে তখন, সহস্রাধিক এঁটো বাসন, আর মেগা সিরিয়ালের শব্দব্যঞ্জনা| ঠিক যখন, জামবনির পাহাড়ঘেরা ধু ধু তিলের ক্ষেতের হাওয়া, এসে লাগে, ঘর লাগোয়া পুরোনো ছাত টায়| অন্ধকারের ক্লান্তি পেরিয়ে, ধীর পায়ে, ছাতের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়ায় ছেলেটি| বাড়ির পিছনের দৈত্যাকার গাছটাও তখন এক্কেবারে একা|
আজ বিকেলে তার রিহার্সাল ছিল না| বেলাশেষের এই অখন্ড অবসরে, দপ্তরী মোমের মিছিল, আর ধ্রুপদ সাহিত্য স্মৃতি বুকে করে, ছেলেটা আবার ছাতে এসে দাঁড়াল| গাছটাও যেন, চোখের পাতা না পড়া দৃষ্টিতে, তাকিয়ে আছে ওর দিকে| ঠিক যেমন জামবনিতে, ওদের বাড়ির পিছনে, বিশাল বটগাছটা চেয়ে থাকত, ফুটিফাঁটা এপ্রিলের দুপুরে| দেখতে দেখতে, গাছটার চোখগুলো অল্প আঁচে জ্বলে ওঠে| ঝুড়িগুলো তার গা বেয়ে নেমে এসেছে, যেন সময়ের কোন অদৃশ্য কোণ থেকে, কালসর্প দোষ ধেয়ে আসছে, হিসেবী রাত্রিবানী বুকে করে| জঙ্গলের ভিতর, করাত কল থেকে ভেসে আসছে, সংস্কারী চৈত্রমাসের, গোত্রহীন যান্ত্রিকতার উপনিষদ| ছেলেটার বাবা, ওই করাত কলটায়, দিনে ১০ ঘন্টা খাটতো| হয়ত এক ফাঁকে, পাশের ভাতের হোটেলে ঢুকত, টিফিন করতে| মোটা চালের পান্তা ভাত,শাকভাজা, সাথে নুন-লেবু-লঙ্কা| গ্রীষ্ম শুরুর দুপুরবেলায়, সমস্ত জঙ্গল জুড়ে যেন, আগুন লেগে যায়| কচি কলাপাতা রঙের নতুন বৌ, যেন গায়ে হলুদের শাড়িখানা, জড়িয়ে নিয়েছে আপাদমস্তক| অস্বাভাবিক আগুন রঙা, ঢ্যাঙা গাছগুলোর, গোড়ার দিক চওড়া হয় ক্রমশঃ| লাল মাটির বুকে, স্থায়ী সমাধানের মত, উঁইয়ের ঢিবি, এবরো-খেবড়ো, আকারহীন, যেন বসন্ত আর বিষফোঁড়া মেশানো, কোনো দেহাতী লোকের মুখ, এক্ষুনি সাপের মত জিভ বার করবে, এঁকে বেঁকে| ছেলেটি শুনতে পায়, দূর গাঁয়ের মেয়ে-বৌদের, গোল হয়ে গাওয়া পরবের গান| জঙ্গলের মাঝে একটা প্রাইমারী স্কুল, স্কুলের গা বেয়ে, পাহাড়ের উপর এঁকে বেঁকে উঠে গেছে, পাকা রাস্তা| যেন পৃথিবীর গা বেয়ে, গড়িয়ে যাওয়া, জ্যোতিষ্কের ত্রিদিবী আবেগ| ছেলেটার এখনো মুখে লেগে আছে, এরকম চালচুলোহীন দুপুরে, ভাত দিয়ে মেখে খাওয়া, ওর মায়ের হাতের পোস্তবাটা| আজ এই মুহূর্তে, বিপন্ন বক্ররেখায়, ভিড় করে এসে দাঁড়ায়, ওর শৈশব-কৈশোর-যৌবন| দূরের ওই শহুরে গাছটা যেন, ওকে দেখে, বিশেষ কোনো এক ভঙ্গিমা করতে চায়| এই ভঙ্গিটা ওর চেনা| ওদের গাঁয়ে মুখ বেঁধে আসত, এক দল লোক, পিঠে রাইফেল| কোন এক বিবাদী রাতের ভোরে, তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওকে| নিজেদের সাথী করেছিল, ওর নতুন নাম দিয়েছিল “কমরেড লাখাই”| লোকগুলো রোজ রাত নামলে, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গ্রামে আসত| কোথাও বাড়ি গিয়ে ভয় দেখাত, কোথাও আবার জনতার দরবারে, চাল ডাল বিলি করত| ওদের কাছে শ্রেণীশত্রু প্রতিপন্ন হলে, তার বিচার ওরা এই জনতার দরবারেই করত| এমনকি আসামীর পরিবারের সামনে, বুলেট পুড়ে দিত, বস্তুবাদী বিপ্লবের শত্রু “বুর্জোয়া” টির বিবস্ত্র, ময়াল শরীরটায়| জোড়হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, উপর দিকে ছুড়ে স্লোগান দিত, “লাল সেলাম”| ছেলেটার, লোকগুলোকে খুব খারাপ লাগত না| কারণ, ওরা এই সমাধিস্থ সমাজের, সরীসৃপ নৈতিকতাকে, লন্ডভন্ড করে দেবার কথা বলত| সমূলদ পরিবর্তন, দিনবদলের ডাক, এই মহাজাগতিক দর্শনগুলো, ক্রমশঃ ছেলেটির চোখের সামনে, নধর চাঁদের মত, অর্ধনারীশ্বর রূপ ধরত| লোকগুলো একটা দল করত, বন্দুক আর বুলেট, যার ক্ষমতার সোপান| ওদের দলের লিডার, ক্রমশঃ হয়ে উঠছিল, এলাকার স্বঘোষিত “রাজা”| এমনই কোন এক, ঘুণ ধরা বিকেলে, লিডার মুন্ডু নিয়েছিল, স্থানীয় জোতদার, জমির দালাল,”মাগলা সারেন” এর| এই মাগলা ই, কোনদিন ছেলেটির বাপকে, নিজের পায়ের জুতো খুলে মেরেছিল, নিতান্ত সামান্য অপরাধে| ছেলেটির এই খুনের বিচার, ভালো লেগেছিল সেদিন| মনে হয়েছিল, পুরু চামড়ার তার এই, স্বজাতিগুলোর কাছে, রাষ্ট্রের অনেক ঋণ| এবার বুঝি, তার শোধ নেবার পালা| প্রতিটি মুণ্ডচ্ছেদে, ছেলেটির কানে বেজে উঠত, অপৌরষেয় শঙ্খধ্বনি| যেমনটা টুসুর ভোরে, সে শুনতে পেত, কোপান নদের ধারে| দেশের ভেতর আরেকটা দেশ, একটা সমান্তরাল পৃথিবী| যেখানে মেঘের আলজিভে, ক্ষুধা, লাল হয়ে ঝরে পরে, এই শুকনো জামবনি, আর তার আশেপাশের ইতর অববাহিকায়|
লোকগুলো মাঝে মাঝে, গ্রামে এসে নাটক করত| এই ছেলেটার বয়সী, অনেকগুলো ছেলেমেয়েকে, একসাথে করে| শহুরে নাগরিকতার কাছে, চিরন্তনী অপাংক্তেয়, গরিব মানুষগুলোর মনে, শ্রেনীবিহীন সমাজ চেতনা গড়ে তোলার জন্য| কখনও ছেলেটিও সেই নাটকে, গাছ হয়েছে| উদ্বাহু হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে, কত শত বৈবস্বত কাল ধরে| দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, তার চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে, হাতের আঙ্গুলগুলো এঁকে বেঁকে গেছে, বৈশাখী বিকেলে, দমকা হাওয়ার, নম্র শরীরী কাব্যের ছন্দ বেয়ে| আজ আবার ছেলেটি, দুটো শীর্ণ হাত তোলে, আকাশের দিকে, সেই বৈদিক জ্যোৎস্নার শূন্যতাকে, দুহাতে ছিড়তে চাওয়া, ভীষণ পূর্ণিমার ধারায়, শরীর ভেজানো, নিঃসঙ্গ ছাতের গা বেয়ে| গাছটার মগডালে, দুটো শালিক বসে ঝগড়া করছিল, নিজেদের ভেতর| কখনও বনিবনা হয় না ওদের| উড়ে যায় এঁকে অন্যকে ছেড়ে| মাধুরী সন্ধ্যের হাওয়ায়, শহরের আলোগুলোর ওপর, মলত্যাগ করতে করতে, উড়তে থাকে শালিকটি| ওরই নাম হয়তো, কোনোদিন কেউ দিয়েছিল “বিপ্লব”|
জামবনি এবং তৎসংলগ্ন এলাকা, এখন ঠান্ডা পিস্তলের মত, শান্ত নির্জনতায় ডুব দিয়েছে, হয়তো আগুপিছু, আবার বছর তিরিশের জন্য| দরিদ্র দুপুরের, নাগরিকত্ত্বকে প্রশ্ন ছুড়ে, ধর্মীয় স্লোগান আর মালকোষী তাটে, বাজানো একাদশী চাঁদ হয়তো, আজ বিপ্লবেরই নামান্তর|
আরো পড়ুন- শাশ্বত বোসের গল্প- আঁচল