প্রচ্ছদসাহিত্য

একগুচ্ছ কবিতা- লাবণ্য কান্তা

বধ্যভূমি শ্রীমঙ্গল

শ্রীমঙ্গল বধ্যভূমি,

বৃষ্টিভেজা সন্ধ্য।

মনে পড়েছে পুনরায় ৭১এর সারিবদ্ধ লাশের কথা,

অর্ধমৃত মানুষের আহাজারি,

রাইফেলের বিকট আওয়াজ, ধর্ষিতাদের আহাজারি

অজানা-অচেনা মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর ব্যথা,

পিতার বুকের গুলি

ভিটেমাটিহারা লক্ষ লক্ষ মানুষের ছুটোছুটি।

বধ্যভূমিতে দাঁড়ালে

মনের গহিনে

নিজের সাথেই হয় নিজের কথা

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বেজে ওঠে পরিচিত করুণ বিউগল।

 

এপারে ধর্ষিতা ওপারে মৃত্যু

লক্ষ্মীছড়া চা-বাগানের দুখিনী শুভদ্রা বাউরি

ছিলো আশ্রয়হীনা এক যুবতী,

সারা বাংলা জুড়ে তখন চলছে পাকসেনাদের আনাগোনা

গুলি-হত্যা,ধর্ষণ,নির্যাতনের চরম সীমানায়

ছিলো সিলেটের চা-বাগানগুলোও।

বাড়িঘর ছেড়ে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে

লক্ষ্মীছড়ার মানুষ চলে গেছে ওপারে; কিন্তু

শুভদ্রা তো আশ্রয়হীনা, কে নিবে তাকে সাথে?

 

না, শুভদ্রা কোথাও যায়নি,তার কোনো পথ চেনা নেই,

কোথায় যাবে নিজের প্রাণটাকে নিয়ে?

কে বলবে তাকে পালিয়ে যেতে?

নিজের জীবন বাঁচানোই দায়…

আশ্রয়হীনা শুভদ্রা একা, কেবল একা লক্ষ্মীছড়া

চা-বাগানের পথে পথে কাটতে থাকে তার

তুমুল যুদ্ধের দিন।

কাউকে দেখলে সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে

কখনো সবুজ চায়ের বাগানে,

কখনো ঝোপে-ঝাড়ে, কখনো পাহাড়ে।

 

একদিন শুভদ্রা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে কোথায় যেন,

হঠাৎ জলপাই রঙের গাড়িটি এসে থেমে যায়

তার চোখের সামনে, কতগুলো হায়েনার লাল চোখ

দেখে শুভদ্রা জ্ঞান হারায়।

হায়নাদের হাত তাকে স্পর্শ করে, শুভদ্রা নির্বাক,

হায়নার দল শুভদ্রাকে নিয়ে গেলো

রশিদাবাদ চা-বাগানের ক্যাম্পে।

না, শুভদ্রার কথা আর বলা গেলো না,

একদিন শুভদ্রা নিজের রক্তাক্ত নিথর দেহটাকে

টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পালানোর পথ চিনে নিলো।

এপার থেকে অবশ দেহটাকে নিয়ে ওপারে

যেতে যেতে, যেতে যেতে, যেতে যেতে

ওপারের পথেই সে একদিন মরে গেলো।

 

মণিপুর চা-বাগানের গেস্ট হাউস

ত্রিশ ছুঁই ছুঁই অহল্যা সুন্দরীকে স্থানীয় রাজাকারের দল

প্রতিদিন টেনে টুনে নিয়ে পৌঁছে দিতো

মণিপুর চা-বাগানের গেস্ট হাউসে; তাদের প্রভুদের

মনোরঞ্জনের জন্য, দৃশ্যটি বড় করুণ,

বড় হৃদয় বিদারক সে দৃশ্য।

অহল্যার বাপটা দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে

লালমাটির উঠোনে তুলসীতলায়; আর অহল্যার

স্বামী গোলাবের শিরায় শিরায় রক্তে আগুন ধরে যায়

কিন্তু তাকেও সেই দৃশ্য দেখতে হয় প্রতিদিন।

দুটি পুরুষের নির্বাক উপস্থিতি

রাজাকারের অট্টহাসির পাঁচমিশেলি খোরাক।

সে কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে হাসে, আর যাওয়ার সময় বলে যায়

সকালেই নিয়ে আসবো।

সারারাত গোলাবের ঘুম আসে না, অহল্যার শুকনো

আর কাতর মুখটা তার চোখে ভাসে…

গোলাব নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ে আর একটি

নতুন ভোরের জন্য অপেক্ষায় থাকে।

একটা নতুন ভোর আসে, ভোরের আলোয়ে অহল্যাও আসে,

কিন্তু এ কোন অহল্যা!

অহল্যার দেহটা স্তব্ধ, কথা বলতে পারে না,

হাঁটতে পারে না,যেন জ্যান্ত একটা লাশ।

দিনের পর দিন অহল্যার ওপর চলে পৈশাচিক অপকর্ম,

অহল্যা পালাতে পারে না, সে পালালে

বাপটাকে মেরে ফেলবে, স্বামীটাকে গুলি করবে

পথে যেতে যেতে রাজাকারটি রোজ অহল্যাকে এই কথাটি বলে।

বাঘের থাবায় আর কতটাই বা অহল্যা নিজেকে

রক্ষা করবে!একদিন তার দেহটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।

 

আরও পড়ুন- জহুর কবিরের গীতিকবিতা

 

error: Content is protected !!