শ্রীজাত এর কাপলেট
১. যে তোমাকে শিখিয়েছে দখলের কথা,
জেনো সে ধর্মই নয়। প্রাতিষ্ঠানিকতা।
২. দূর থেকে মনে হয় অলংকার। কাছে গেলে ক্রুশ।
সফল ভেবেছ যাকে, সে আসলে বিষণ্ণ মানুষ।
৩. মুছে তো দেবে না কেউ, ভুলে যেতে হবে তোমাকেই।
বৃষ্টির চাইতে ভাল ব্যাকস্পেস পৃথিবীতে নেই।
৪. কবে মরে গেছে নদী, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে দেশও…
আমার সময় শেষ। তোমার সময় হলে এসো।
৫. যে বলছে জানত না কিছুই, সে আসলে জানত।
আমি কখন ‘না’ বলব তা আমারই সিদ্ধান্ত।
৬. শব্দ পেলে ঝরে যায়। নীরবতা পেলে তবু বাঁচে।
একা ওই ঠোঁটফুল, মুখের বাগানে ফুটে আছে।
৭. জ্বলেছে আগুন যেন, নুয়ে পড়া পলাশের শাখে –
শিরা-কেটে-ফেলা হাত বরাবরই লাল হয়ে থাকে।
৮. এখানে সময় বালি। দূরে যত আয়ু, মরীচিকা।
সন্ধে আর কেউ নয়। মার্কেজের বিষণ্ণ গণিকা।
৯. কে কখন বহুমূল্য হয়ে ওঠে অতীতবিচারে,
ডালের ফোড়নগন্ধ বহু দূর নিয়ে যেতে পারে…
১০. ঘরে সব এলোমেলো, শহরের হাল দুর্বিষহ
এমন বৃষ্টিতে বাড়ে অপরাধ এবং বিরহ..
১১. বৃষ্টি ছিল, হাওয়া দিচ্ছে। মনে হয় বৃষ্টি হবে আরও।
এরকম দিনে বুঝি কাজ করতে ইচ্ছে করে কারও?
১২. হাতের পাতায় সকাল আমার দু’এক মুঠ্ঠি চাওয়ল…
বেলার দিকে রান্না হবে আলহাইয়া বিলাওয়ল।
১৩. শিকারি তো জাগরণ। স্মৃতি গেঁথে রাখে হারপুনে।
সমুদ্রের দিন যায়, তিমির মিলনকান্না শুনে…
১৪. বয়স পাহাড়ি ঝোরা। দেখা হয়ে যায় কোনও বাঁকে…
চলমান তুমি নও। রাস্তা নিজে পেরোয় তোমাকে।
১৫. মেধা তো জয়ের পক্ষে। সে তার উল্লাস নিয়ে বাঁচে।
হৃদয় তবুও ছোটে হেরে যাওয়া মানুষের কাছে..
১৬. স্মৃতি তো পুরনো বন্ধু, এসে পড়ে কাজের সময়
যেখানে যা মনে পড়ে, সেখানে তা স্মরণীয় নয়।
১৭. সহজে হারানো সুখ আমাকে ফিরিয়ে দিও, পেলে…
আবার অরুণ মিত্র পোড়ো তুমি। যে-কোনও বিকেলে।
১৮. পাতা যত বৃষ্টি পায়, তত জল যায় না শিকড়ে
নিজের দু’হাত দেখে বাবার রোজগার মনে পড়ে।
১৯.বহু আয়োজনে মোড়া অর্থহীন পৃথিবীর মানে
আমি কিছু জানি আর তোমার গিটার কিছু জানে।
২০. পুরনো গানের গন্ধ, আনকোরা রঙে তাকে শোনো…
একই পথে ফেরো, তবু ফেরা এক হয় না কখনও।
২১. নিদ্রা তো কাচের পাত্র। বেশিক্ষণ হাতে রাখা দায়।
স্বপ্নের ভিতরে গ্লাস পড়ে গেলে ঘুম ভেঙে যায়।
২২. লেখা তো ভাষার বন্ধু। অভিধানে প্রতিবেশী চেনা।
সুগন্ধী ফরাসি হলে তার কোনও তর্জমা লাগে না।
২৩. দিন গেছে এঁকেবেঁকে… মুহূর্তের টুকরো ধারে ধারে…
আলস্য আশ্চর্য পশু। সে একা সময় খেতে পারে।
২৪. অনেক কাঠের দামে আমাদের কারিগর কেনা
আসবাব যে তৈরি করে, সে কখনও অরণ্যে যাবে না।
২৫. সরু সাদা বাড়ি দিয়ে চিঠি লেখা, স্লেটের আকাশে…
বন্ধুর বোনের মতো ছোট দিন। মেঘ করে আসে।
২৬. জলের গায়ে ভাসছে কেমন শুভেচ্ছাময় দিন…
যার কিনারে দেখা, সেই হ্রদের কাছে ঋণ।
২৭.মেঘ তো নতুন নয়, কবেকার পুরনো তো জলও
তবু ভাল হয়, যদি বৃষ্টির বিষয়ে কিছু বলো।
২৮. নিজেকে ফেরানো মানে আসলে নিজেরই কাছে ফেরা,
গাছের বাহানা দিয়ে ছায়া কেটে আনে কাঠুরেরা।
২৯. একা গান চিরকালই তেজী ঘোড়াদের চেয়ে দামি
সময়ে গিটার পেলে রাজ্য জয় করে নেব আমি।
৩০. ছাতা নিয়ে বেরোইনি, লেখা থেকে বহু দূরে ঘর…
উপন্যাসে জোর বৃষ্টি। আমার শরীরে আসে জ্বর।
শ্রীজাত এর কাপলেট
৩১. হত্যার প্রমাণ নেই। জোনাকিরা এখানে প্রবাসী।
তুমি চুল খুলে রাখো। আমি চাই চিরুনি তল্লাসি।
৩২. প্রতিবন্ধী ফুল যেন, তেমনই তো মনে হয় দেখে
অসময়ে যতবার লেখা থেকে ছিঁড়েছি নিজেকে।
৩৩. ভালবাসা কাছে এলে ভয় পেয়ে যায় শুধু সে-ই –
সব কিছু আছে যার। জড়িয়ে ধরার কেউ নেই।
৩৪. যদি কিছু বিক্রি হয়? এই ভেবে, পুরনো দোকানে
ভাঙা উপন্যাস থেকে ছোট গল্প খুলে খুলে আনে।
৩৫. যখন বিষাদকুচি শিরায় সুরের মতো ঢোকে,
তখন তফাত নেই, খুনি আর বেহালাবাদকে।
৩৬. জেগে যাকে হারিয়েছি, তাকে খুঁজে এনে দেবে ঘুম…
মাঝে কি সময় গুনবে? হে অবচেতন, ডার্ক রুম?
৩৭. উচ্চারণ খ্যাতি পায় ততদূর, যতদূর ভাষা।
তারপর হাওয়া, আর ক্রমশ নীরব হয়ে আসা…
৩৮. জীবন, নতুন জামা, মাঝেমধ্যে ভেজা প্রয়োজন
তোমার স্মৃতির চেয়ে বেশি নয়, বৃষ্টির ওজন।
৩৯. তুমি যত মুঠো ভরো, বালি ছেড়ে পালায় তোমাকে…
যখন থাকে না লেখা, লেখা না-থাকার ভয় থাকে।
৪০. সব স্পর্শ ভাঙা কাচ, সব বাক্য বিরহসম্ভবা
যে-কোনও পানশালাই আসলে রঙিন শোকসভা…
৪১. শব্দ সে, আমার কাছে। জুঁই, চাঁপা, মোগরা, চন্দন…
অন্ধ ধূপ-বিক্রেতাই দেখতে পান, সুগন্ধ কেমন।
৪২. বহু ভ্রমণের শেষে আবার নিজের কাছে ফেরা,
যেরকম জল হয়, অবসরপ্রাপ্ত বরফেরা…
৪৩. প্রয়োজন নেই আর রোদ-জল-বাতাস দেবার –
সাজিয়ে রেখেছি ঘরে, ফুলদানিভর্তি চিৎকার।
৪৪. ওদিকের শুকনো পাতা এদিকে তুলেছে আলোড়ন…
তুমি যাকে ঝড় ভাবো, সে আসলে ছাদের পিওন।
৪৫. স্বপ্নের চূড়ায় বাড়ি। ধোঁয়া না। স্মৃতির বনসাই।
অন্য কেউ সেজে আসি। নিজেকে না পেয়ে ফিরে যাই।
৪৬. প্রবীণ অরণ্য সেও। মাঠে মাঠে হরিণের কাশ…
আমিও পড়ন্ত রোদ। ভাঙা চিঠি। বাঘের সন্ন্যাস।
৪৭. একই তো ধূসর স্মৃতি, একই ঘাসে সফেদের ছোপ…
তোমার তুষার থেকে দূরে নয় আমার বরফ।
৪৮. আমাদের থেকে গেল ছাইয়ের পাহাড় শুধু, মাঝেমধ্যে আগুনের স্নান…
এতদিনে তুমি ঠিক পেয়ে গেছ ফুলের বাগান।
৪৯. একজন মানুষ যদি রক্ত দিয়ে কথা বলে ওঠে –
সমস্ত সেলাই এসে জড়ো হয় আমাদের ঠোঁটে।
৫০. একই রেখার এদিক ওদিক শিল্পী ও বিক্রেতা –
সীমা কোথায় টানবে, তুমিই ঠিক করে নাও সেটা।
৫১. তাকাই না আর অনেকদিনই, হাত ছেড়েছি পথের ধারে…
নিজের দিকে চোখ চলে যায়, আয়না দেখার সংস্কারে।
৫২. ঝাপসা বৃষ্টি… পিছল সড়ক… চশমাবিহীন চোখে
একলা হেঁটে যেতে দেখছি, মণীন্দ্র গুপ্তকে…
৫৩. পায়চারিমন একলা কোথায়, বিষণ্ণতার গাঁটছড়া –
লেখার কাছে হাত রেখেছি, ঘুমের কাছে হাতকড়া…
৫৪. আবার নিশ্চিন্তে শুই… ফের শান্ত হয়ে আসে স্নায়ু…
না ঘুম, না জাগরণ, না অপেক্ষা। কফিনই জরায়ু।
৫৫. শীতে কে বনান্তে যায়, সকলে শহরে শোক রাঁধে…
আমিও পেয়েছি ভাগ, কাঠ কেটে আনার সুবাদে।
৫৬. লেখার অরণ্যে ঘুরে আমরাও হারিয়ে যাই পাছে,
একই সে কবিতাগাছ, দু’দিকে বিস্তার মেলে আছে…
৫৭. বাতাসও তো অভিধান, অর্থহীন নয় কোনও ধ্বনি –
যে-যুবতী ভাষাহীন, তুমি তার পিয়ানো শোনোনি।
৫৮. আমার হরিণজন্ম, মৃদু পায়ে সাবধানী কথা…
জল খেতে গেলে ছায়া কেঁপে ওঠে। অসাবধানতা।
৫৯. চিন্তাও আসলে স্রোত। জমে যায় শীতের সময়।
চুপ ক’রে রোদে বোসো। রোজ তো লেখার দিন নয়।
৬০. মায়া তো রাত্রির প্রাণি। আত্মীয়তা জ্যোৎস্নার বিষয়।
যারা জল নিতে আসে, তারা পুকুরের কেউ নয়।
৬১. ভুলে থাকা, ভিজে যাওয়া। কোনও লাভ হয়নি আখেরে।
বৃষ্টিও স্মৃতিরই মতো। বহুদূর তাড়া ক’রে ফেরে…
৬২. বহু নীচে মুছে যায় জোনাকির মতো কিছু প্লেন…
এক বৃদ্ধ মহাকাশে একা একা রাস্তা পেরোলেন।
৬৩. শিকারের বহু পরে জেগে ওঠে ব্যূহ। বধ্যভূমি।
মৃত মাছেদের স্তূপে বঁটি নিয়ে বসে থাকো তুমি।
৬৪. যতই উড়িয়ে দাও কাছে দূরে কাগজে আকাশে –
লেখার সমস্ত শব্দ লেখার কাছেই ফিরে আসে।
৬৫. ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম।
অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম…
৬৬. এ এক আজব বৃত্ত, শুরুতেই শেষ লেখা থাকে
যে-গাছ দিয়েছে ছায়া, তারই কাঠ পোড়াবে তোমাকে।
৬৭. বাগানে ঘাসের গুচ্ছ, পাহাড়ে বহু রকম সাদা…
কথা সকলেরই এক। নীরবতা আলাদা আলাদা।
৬৮. শ্রাবণব্যাপারী আমি, মেঘে মেঘে আমার উপায়
যত উপার্জন করি, বৃষ্টিতে খরচ হয়ে যায়..
৬৯. কিনে নিতে পারো লেখা, বিক্রি করে দিতে পারি গানও…
আমার শরীর আজ দোকান হয়েছে, তুমি জানো।
৭০. জীবন, তোমার কাছে শিখেছি সমস্ত কিছু, তাই
আজ এই জ্যোৎস্নার জলে তোমাকেই প্রণাম জানাই।
শ্রীজাত এর কাপলেট
৭১. যেন-বা বিরোধ নেই, ভালবেসে থাকবে প্রত্যেকে…
এমনই বিশ্বাস হয়, মানুষের আনাগোনা দেখে।
৭২. এখানে নীলাভ আঁচ, ছোটখাটো গানের কৌশলে
মানুষ নতুনভাবে পুরনো দুঃখের কথা বলে।
৭৩. দৃষ্টিই সারে না। কিছু উদাসীন থাকে, কিছু শ্যেনও…
যে ঘোড়া স্বাধীন, তারও লাগামের স্মৃতি আছে জেনো।
৭৪. কুড়িয়ে নিয়েছি ছায়া। লেগে ছিল জলের কিনারে।
কখনও থাকার চেয়ে ছেড়ে যাওয়া ভাল হতে পারে।
৭৫. নিশ্চিত জয়ের জন্য ছুটে যায় নিরাপদ শ্রেণী…
কী বুঝবে হারের নেশা, কোনওদিন জুয়া যে খেলেনি?
৭৬. চেহারাই স্থির করে, আয়না কতখানি অভিজাত।
নিজেকে যেভাবে দেখি, তোমাকে সেভাবে দেখি না তো..
৭৭. তুমি যদি বারংবার কোপ মারতে পারো,
ছিন্ন কাঁধে ফের মাথা জন্মাবে আমারও!
৭৮. যে-মেঘ পেরোয় কাঁটাতার, অহরহ,
সেও কি তাহলে রাষ্ট্রবিরোধী নয়?
৭৯. তুমি যাকে ভুলে গেছ, তোমাকে রেখেছে মনে সে-ই।
কেননা ক্ষমার চেয়ে বড় কোনও প্রতিশোধ নেই।
৮০. বছরই নতুন শুধু। সেই এক হৃদয়সুমারি।
শত্রুরা থাকুক। যেন বন্ধুদের চিনে নিতে পারি।
৮১. গানবাজনাই ধর্ম মানি। খবর বিশেষ রাখি না বাদবাকির।
আমার দেশে শিব যিনি, তাঁর আজীবনের সঙ্গী হলেন জাকির।
৮২. রাস্তায় বেরনোমাত্র যত মুখ, পরিচয়হীনা,
পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। চোখ তুলে তাকাতে পারি না।
৮৩. ইদানীং ভয় হয়, চোখ পড়ে আয়নায় যখন…
কে জানে, আমারও মধ্যে আছে কিনা ধর্ষকের মন!
৮৪. এসব পথেই বিকেল ঘনায়, এসব পথেই হেমন্ত যায় শীতে
নতুন লেখা শুরুর আগে বাতাস এসে দাঁড়াচ্ছে, দম নিতে…
৮৫. আমরা কি চাই, জন্মদিনের জ্যোৎস্না তাঁকে ছাড়ুক?
রুপোলি এই বাংলা ভাষায় চিরকালের শাহরুখ!
৮৬. সাধে কি মাঠ শিউরে ওঠে? আকাশ বুকে ঝাঁপায়?
এক-পৃথিবী সম্মোহনী, সোনায় মোড়া বাঁ পা’য়!
৮৭. পিঠে বাঁধা অভিধান। সকলকে শব্দ দিয়ে চেনা।
সন্ধে নেমে আসে শুধু। পাখিদের দোভাষী লাগে না।
৮৮. সাত সমুদ্র পেরিয়ে এসেও আঙুলে সেই রঙিন ফিতে…
ঠিক ছুঁয়ে যাই ঠাকুরদালান, অন্য পাড়ার অষ্টমীতে!
৮৯. আলগা মুঠোয় সামলে নিয়ে বল্গাবিহীন ইচ্ছেদের –
আমরা দু’জন বন্দি হলাম মাসখানেকের বিচ্ছেদে…
৯০. এ কথা নিশ্চয়ই মানো, অর্জনের কিছুটা যে ব্যয়?
তুমি পক্ষ নিতে গেলে পক্ষও তোমাকে নিয়ে নেয়।
৯১. তবু বারবার তোকে ডাক দিই। এ কি উপহার, নাকি শাস্তি?
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম, আর তুই কাকে ভালবাসতিস…
৯২. বিষাদ তো ব্যক্তিগত। যেন সন্ধে, কবরখানায়…
ভালবাসা নয়, জেনো, গোলাপ-বিক্রেতা টাকা চায়।
৯৩. কফিন ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে থাকে স্মৃতির পেরেক।
মৃত্যুর সংস্করণ একটাই। মুদ্রণ অনেক।
৯৪. এখন বাস্তব বলে মনে হচ্ছে, তাই তুমি নিশ্চিত, সমস্ত পথ চেনা
একদিন মারা যাব ঘুমের ভেতর, তুমি স্বপ্ন থেকে বেরোতে পারবে না…
৯৫. সব ঘুঁটি উঠে গেছে। এই দানে খেলা প্রায় শেষই।
যখন বুঝেছ তুমি, ক্যালেন্ডারে মৃত্যুদিনই বেশি…
৯৬. চেষ্টার সমুদ্রে ঘেরা ব্যর্থতার এই মহাদেশ…
কবিতা তো আত্মঘাত। সফলতা পেলে তুমি শেষ।
৯৭. কথার খাতিরে ভাষা। ভাষার জন্যই এত কথা।
সমস্ত ভাষায় এক, দুঃখী মানুষের নীরবতা।
৯৮. একা হলে বোঝা যায়, এ জীবন ঘটনাবহুল
আমাকে বিরক্ত করে ঝরে গেছে দু’টি বুনো ফুল।
৯৯. আমার ঝরেছে পাতা… তোমার রঙের অন্ত নেই…
সান্ত্বনা এটুকু, আজও বসন্ত যে শীতের পরেই।
১০০. কী জটিল বোঝাপড়া। ছাদপিছু কত রোদ ব্যয়।
বেলা পড়ে আসে আর মানুষ কাপড় তুলে নেয়…
১০১. পাহাড় পথের বাধা। রাস্তা পাতে পাথরের চাঁই।
সারা জীবনের কষ্ট, ছোট ছোট কান্নায় ভাঙাই।
১০২. পালকের শব্দ হবে; নীরবতা নেমে আসবে ফের।
ভাস্করের সঙ্গে যদি দেখা হয়, জীবনানন্দের…
১০৩. বয়স পাথর সেজে জড়ো হয় সময়ের স্রোতে…
দু’পা ভারী হয়ে আসে, মৃত্যুদিন পেরোতে পেরোতে।
১০৪. দূরে ছেড়ে দিয়ে এসে তাকে যত ভেবেছ বিগত –
ভালবাসা ফিরে আসে পথ চিনে। বেড়ালের মতো।
১০৫. অমল সারেনি আজও। রোজ ফুল রেখে যায় সুধা।
অসুখ করেছে খুব। তুমি চিঠি দেবে না, ঋতুদা?
১০৬. সব পথ পার ক’রে, পৃথিবীর অন্তিম বিকেলে
কবিতা নির্জন হয়। শম্ভু রক্ষিত চলে গেলে।
১০৭. যে বলে, ‘তুই সারা জীবন এমনি করেই খুব ভোগাস!’
আজ তারই হাত উপচে দিলাম জন্মদিনের দুব্বোঘাস…
১০৮. আমরা ভাবি শেষ হলো সব, মানুষ যখন ভাসান যায়
একটি নদীর দুঃখ নিয়ে একলা হলেন দেবেশ রায়…
১০৯. শব্দ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা আমার পক্ষে সম্ভবও না
নতুন লেখা শেষের পরে যে-অতৃপ্তি, তার তুলনা।
১১০. অনেক রোদের রং মিশিয়ে সারং বানায় সা-এর দিন,
আজ শুধু তা বলছি মুখে, আসলে রোজ মায়ের দিন।
১১১. রুটিই বিভেদরেখা, ঘুমন্তের মাথায় ও ধড়ে
আমি ঠিকই বেঁচে থাকি। আমার বিবেক কাটা পড়ে।
১১২. জীবন আলাদা ছিল। চলে যাওয়া একমাত্র মিল।
শোকযাত্রা নেই কোনও, মৃত্যু তাই নিজেই মিছিল।
১১৩. যত ভাবি স্মৃতি শেষ, ফের ভরে উঠেছে কখন…
এমন বৃষ্টির নীচে পানপাত্র হয়ে যায় মন।
১১৪. রাতে জাগা পাখিদের হাতে কোনো কাজ নাই…
দুর্দিনে সাথী হল গান-আড্ডা-বাজনাই!
১১৫. ইদানীং মনে হয়, জীবন স্বপ্নের চেয়ে ছোট।
কী থাকে ঘুমের পরে? যদি তুমি না-ই জেগে ওঠো?
১১৬. সেদিকে মোহনা নয়, যেদিকে চলেছে মূলস্রোত…
এটুকু বুঝেছি আমি, যা বুঝিনি, সেটাই মহৎ।
১১৭. মনখারাপের সারি, পাশাপাশি মোমেরা ছোঁয়াচে…
ঘর লুকিয়েছে মুখ। বারান্দারা আলো হয়ে আছে।
১১৮. স্বপ্ন সেই মরুভূমি, মরীচিকা এই অভিপ্রায় –
ঠিকানা বলার পর ঘোড়াগুলি দূরে সরে যায়।
১১৯. রুপোর দূরত্ব নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে জল…
ছাদে পরাধীন শাড়ি। বৃদ্ধাবাসে জ্যোৎস্নার শেকল।
১২০. এ সেই আজব জ্বর, দু’দিকেই সমান পারদ –
লিখলে ব্যর্থতা আর না-লিখলে অপরাধবোধ।
১২১. বুকে লেগে আছে স্বপ্ন, চোখে বিঁধে আছে স্মৃতিরেশও…
এখনও সময় হয়নি। কিছু পরে ফুল দিতে এসো।
১২২. সে কোন দেশের তুমি, সে কোন ভাষার অধিবাসী…
সেসব বুঝি না। শুধু ছন্দ বুঝি, তাই ভালবাসি।
১২৩. সাদা ভাবনার সারি। মাঝেমাঝে কালো দাগ। ক্ষত।
জানলে বাজানো যায়। কিছু মন পিয়ানোর মতো।
১২৪. সমস্ত সুগন্ধ, রং সহজে বিলিয়ে মূলস্রোতে
জনপ্রিয় একটি ফুল, একা হতে চেয়ে, দূরে ফোটে।
১২৫. নতুনই চিরকালীন, পৃথিবীতে। বদলই সাবেকি।
যে-রাতের কেউ নেই, তাকেও সকাল হতে দেখি।
১২৬. সবাই সবার বন্ধু, কিন্তু কেউ কারও বন্ধু নয়
কত স্বাভাবিক ভাবে অভিনয় করে যেতে হয়…
১২৭. পানীয়ে ব্যথার বীজ, বাতাসে স্মৃতির বোনা ক্ষত…
এখনও তোমার প্রেমে পড়ে আছি। কবিতার মতো।
১২৮. কে তাকে তাড়ায় দূরে, পথে চাপা পড়ে সে কখন…
বেড়ালের মতো হয়, হেরে যাওয়া মানুষের মন।
১২৯. বিরহলোভ না থাকলে সে তোমাকে মন দিত?
সমস্ত বিচ্ছেদই জেনো অপেক্ষাবন্দিত…
১৩০. ঝড় যত ক্ষতি করে, তত বেশি কষ্ট পায় হাওয়া…
তুমি যে আঘাত করো, সেটাই তোমার সাজা পাওয়া।
শ্রীজাত এর কাপলেট
১৩১. গাছের বিরহ থেকে দূরে থাকি। তুমিও তো জানো,
কতটা কঠিন ছিল পৃথিবীতে বাগান বানানো…
১৩২. মনে রাখিনি মিথ্যে, তবু করিনি মার্জনা —
তুমিও জানো, এখানে কেউ অপরিহার্য না।
১৩৩. তুমি ঠিক করে নাও, কতখানি তোমার রসদ —
ভালবাসা অধিকার। বাকিটুকু অধিকারবোধ।
১৩৪. ছুটিগাছে পাতা নেই। জীবিকাপাখির ছায়া ওড়ে।
এখনও ডানার মতো সন্ধে নামে আমার শহরে…
১৩৫. এত যে আকাশ ভাঙছে, কিছু দুঃখ ছিল তো শীতেরও
এমন বৃষ্টির পর তুমি যদি তার কাছে ফেরো…
১৩৬. মাঝবয়সের জলে সন্ধের সমুদ্র ভালবাসি…
ডুবন্ত সূর্যের কাছে নিজের আয়না রেখে আসি।
১৩৭. মন তো সহজই ছিল। কী জটিল পৃথিবীর ভাষা…
ঘোষণা করেছি ঘৃণা। গোপন করেছি ভালবাসা।
১৩৮. কাজের অরণ্যে আছি, কে পারে আমায় ছুটি দিতে —
কোনও রবিবার নেই শঙ্খ ঘোষহীন পৃথিবীতে।
১৩৯. সমস্ত সুগন্ধ, রং সহজে বিলিয়ে মূলস্রোতে
জনপ্রিয় একটি ফুল, একা হতে চেয়ে, দূরে ফোটে।
১৪০. ছোঁবে, কিন্তু দূর থেকে। সে এমনই সংকেতব্যাপারী।
কী হবে সমুদ্রে এসে, যদি না জলেই যেতে পারি?
১৪১. ভ্রমর যদি গুঞ্জরী হয়, নেবে কি তার কানন দায়?
মৌ-পিয়াসী’র শৌখিনতায় বৌ’কে দেখি সানন্দায়!
১৪২. অন্তরাতেই বীজ থাকে তার। নইলে সে সঞ্চারী না।
স্মৃতি যখন প্রস্তুতি নেয়, আমরা বুঝতে পারি না
১৪৩. বন্ধুরা কথা কমিয়ে দিয়েছে, শত্রুরা কাছে আসছে…
এরই মাঝে এক বেখেয়ালি হাওয়া কী ভীষণ ভালবাসছে!
১৪৪. এখন ধুলো জমে। স্মৃতি তো বন্ধুস্থানীয়।
পুরনো বইগুলো তোমাকে দিতে চাই। জানিও।
১৪৫. ভালবাসা একদিন যত ব্যথা দিয়েছে তোমাকে,
ছেড়ে গেলে মেঘ ডেকো। ফিরে এলে বৃষ্টি বোলো তাকে।
১৪৬. কয়েকদিনের বৃষ্টিশেষে আমরা কেবল জানতে পারি
একলা হওয়া সব মানুষের বর্ষাকালই হত্যাকারী।
১৪৭. বর্ষাকাল ভবিষ্যৎ। কুয়াশা তোমার পূর্বসূরি।
তুমি যে-ভাষার কর্মী, সে-ভাষায় বিস্মৃতি মজুরি।
১৪৮. অতীত ঝাপসা কাচ। কত দূর কে জানে পৌঁছলে…
স্বপ্নে জল জমে যায়, ঘুমের ভেতরে বৃষ্টি হলে।
১৪৯. মুখ ভেসে গেছে জলে। তোমাকে মুখোশ দিয়ে চেনা।
আয়না এত সাবধানী, বৃষ্টি ধরে, তবুও ভেজে না…
১৫০. থাকা তো অছিলা মাত্র। না-থাকা ভরিয়ে দিতে আসি।
জীবন কিছুই নয়। মৃত্যুর পরের স্মৃতিরাশি।
১৫১. দেখা হবে আয়নায়, একা হবে সবার মিছিলে
যে-মন ওষুধে সারে, তাকে তুমি ভালবাসা দিলে…
১৫২. সহজে ডোবে না দেহ। শুধু জানি আমার ভাষায়
জীবনাবসান বললে মৃত্যুর ওজন বেড়ে যায়।
১৫৩. একটি মৃত্যুর শেষে মুখ দেখি আরেক মৃত্যুর —
আমরা জানি না কেউ, কার বাঁচা আর কত দূর…
১৫৪. সভ্যতার অভিধানে খামতি শুধু এই —
মায়ের কান্নার কোনও প্রতিশব্দ নেই।
১৫৫. বিরহলোভ না থাকলে সে তোমাকে মন দিত?
সমস্ত বিচ্ছেদই জেনো অপেক্ষাবন্দিত…
*সোর্স- ফেসবুক
কবি পরিচিত: কবি শ্রীজাত। প্রকৃত নাম শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়। জন্ম জন্ম ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭৫ সালে কলকাতায়। ২০০৪ সালে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হলো- উড়ন্ত সব জোকার, চিড়িয়াখানা, বর্ষামঙ্গল, অকালবৈশাখী, বোম্বে টু গোয়া, কর্কটক্রান্তির দেশ ইত্যাদি। শ্রীজাত কলকাতার চলচ্চিত্রের জন্য গান রচনায়ও সুখ্যাত।
আরও পড়ুন- অনুপম রায়ের কবিতা